কুড়িগ্রামে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় ভেঙ্গে পড়ছে শিক্ষা মান। ভাড়াটিয়া বা প্রক্সি শিক্ষক দ্বারা চলছে প্রাইমারী বিদ্যালয়। অথচ দিনের দিন পর বিদ্যালয়ে উপস্থিত না থেকেও নিয়মিত বেতন ভাতা তুলছেন শিক্ষকরা। এতে করে সরকারের মান সম্মত শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে না প্রত্যন্ত জনপদে।
সরেজমিনে দেখাযায়,কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার চর নুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উড়ছে জাতীয় পতাকা। কিন্তু বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষসহ শিক্ষকের অফিস কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায়। শ্রেণী কক্ষের বেঞ্চ,চেয়ার,টেবিল গুলো এলোমেলা ভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে। জানালা গুলোতেও মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে। শ্রেণী কক্ষে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। দেখে মনে হয় না চলমান বিদ্যালয় এটি। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রায় ৮মাস ধরে এই বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গো চরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত বিদ্যালয়ে না এসেও হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর করেন ৪জন শিক্ষক। স্থানীয় শিক্ষা বিভাগকে ম্যানেজ করে বেতন ভাতা তুলছেন অনায়সে। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রভাবশালী মহলের আত্নীয় হওয়ায় বিদ্যালয় চলে তাদের খেয়াল খুশি মতো। এতে করে বিদ্যালয়ের দুশতাধিকেরও বেশি শিক্ষার্থীরা এখন সরকারি পাঠদান হতে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় চালু না থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেকে মাদ্রাসা আবার অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই বিদ্যালয়ের পাশে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এখন কোন রকমে একটি ছাপড়া তুলে পাঠদান চলছে। তবে এই বিদ্যালয়ের প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদান নিচ্ছেন দুজন শিক্ষক। তবে তারা কেউই নিয়োগ প্রাপ্ত নয় ভাড়াটিয়া শিক্ষক বা প্রক্সি শিক্ষক। প্রতিমাসে ৩/৪ হাজার টাকায় প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ বিদ্যালয়ের ৪জন শিক্ষক জেলা শহরসহ ঢাকায় অবস্থান করলেও শিক্ষক হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিয়মিত। বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা প্রক্সি শিক্ষক ছাড়া অন্য নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের চেনে না।
স্থানীয় অভিভাবক গোলজার হোসেন বলেন,আমাদের চরনুনখাওয়া সরকারি স্কুল ৭/৮মাস ধরে বন্ধ। শুধু প্রতিদিন জাতীয় পতাকা তোলা হয়। কোন শিক্ষক আসে না। তাই বাচ্চারাও স্কুল আসে না। সরকারি স্কুল বন্ধ থাকায় এলাকার যাদের একটু বিত্তবান তারা টাকা দিয়ে শিক্ষক রেখে কোচিং করিয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করছে।
আমিনা বেগম বলেন,প্রায় ৮মাস ধরে সরকারি স্কুল বন্ধ।এলাকার বাচ্চারা পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হলেও কারও কোন উদ্যোগ নেই। সরকারি মাস্টাররা তো ঠিকই সরকারের বেতন ভাতা নিচ্ছে।
রিপন আহমেদ বলেন,আমাদের যাত্রাপুরে দলীয় কিংবা প্রভাবশালী মহলের স্বজনরা শহরের স্কুল থেকে বদলি নিয়ে এসে প্রত্যন্ত এলাকায় যোগদান করেন। এরপর থেকে আর তারা স্কুল করেন না। প্রক্সি শিক্ষক বা ভাড়াটিয়া শিক্ষক দ্বারা এসব স্কুল চলে। এই প্রক্সি শিক্ষকের নেই কোন প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা। তারা কি শিক্ষা দিবে সন্তানদের। এজন্য আমাদের এলাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা ভেস্থে যাচ্ছে ।
এরশাদ হক বলেন,স্থানীয় শিক্ষা বিভাগ সব জানে কারা কারা স্কুল আসে না। তবুও কোন ব্যবস্থা নেয় না। কারণ যেসব শিক্ষক এই বিদ্যালয় গুলোতে চাকুরি করেন তারা কেউ রাজনীতির সাথে জড়িত আবার কেউ প্রভাবশালী মহলের স্বজন।
মিনা বেগম বলেন,সরকারি স্কুলের শিক্ষক তো আসে না। প্রক্সি মাস্টারও নিয়মিত ক্লাস নেয় না। যেদিন চেয়ারম্যান,মেম্বার,কোন অফিসার আসে সেদিন করে প্রক্সি শিক্ষকরা ক্লাস নেয়। সেটাও দুই/তিন ঘন্টা ক্লাস হয়। কোনদিন ফুল ক্লাস হয় না। স্কুল না এসেও কিভাবে প্রতিদিন হাজিরা খাতায় উপস্থিত হয় তারাই ভালো জানে।
চরভগবতিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমির হোসেন বলেন,আমাদের স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণী যেসব ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে তারা এখনো বানান,রিডিং পড়া,উচ্চারণ,হাতের লেখা এগুলো পারে না। যে বিষয় গুলো প্রাইমারীতে শেষ করার কথা সেগুলো এখন আমাদেরকে শেখাতে হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে।
বরি চান মিয়া বলেন,প্রভাবশালী মহলের স্বজনরা শিক্ষকতার চাকুরি নিয়ে এসব বিদ্যালয়ে যোগদান করে ঠিকই। কিন্তু তারা আর স্কুল আসে না বছরের পর বছর তারা অনুপস্থিত থাকেন। স্থানীয় শিক্ষা বিভাগের নজরে থাকলেও কোন পদক্ষেপ নেই তাদের। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনের সবাই জানে। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয় না।
প্রক্সি শিক্ষক মৌসুমি আক্তার বলেন,আমি সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়মিত প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে ঝুনকার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্নাস নেই। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শহরে এবং ঢাকায় থাকে। স্কুলের শিক্ষকরা হাজিরা কিভাবে দেয় আমরা জানি না। এই বিষয়টি স্কুলের সভাপতি জানেন। আমরা তার মাধ্যমে এখানে প্রক্সি শিক্ষক হিসেবে আছি।
ডাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন,নদী পার হয়ে ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সব গুলোতে প্রক্সি শিক্ষক দ্বারা চলে। নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য যদি সরকার সরকারি ভাবে নৌকার ব্যবস্থা করা যায়,তাহলে শিক্ষকরা প্রশাসনের নজরদারীর মধ্যে আসবে এবং শিক্ষকরা অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।
চর নুনখাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান খান জুয়েল,বিদ্যালয় নিয়মিত না খোলার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,কিছু অভিভাবক এবং বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিকে সরকারের বরাদ্দকৃত টাকার কমিশন না দেয়ায় এমন মিথ্যা অভিযোগ করেছে।
এই বিষয়ে জেলার শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কোন বক্তব্য না পেলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন,প্রক্সি শিক্ষক দ্বারা পাঠদান করার কোন নিয়ম নেই। এছাড়াও প্রভাবশালী মহলের স্বজন যারা বিদ্যালয় যায় না অভিযোগ দিলে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবেন।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post