শেখ নাদীর শাহ্,পাইকগাছা(খুলনা):খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে আশ্রায়নের বাসিন্দা তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) চন্দনার (২০) এর মৃত্যুর এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও অস্বাভাবিক মৃত্যুর রহস্য এখনো উন্মোচন হয়নি।
পরিবারের পক্ষে কোন মামলা না হওয়ায় পুলিশের পক্ষে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
গত ২৩ নভেম্বর রাত পৌনে ১০ টার দিকে আশ্রায়নের নিজ ঘরে আকষ্মিক রহস্যজনক মৃত্যু হয় চন্দনার। খবর পেয়ে রাতেই স্থানীয় হরিঢালীর পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে সুরোতহাল রিপোর্ট শেষে পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করলে কয়রার গ্রামের বাড়িতে তার সৎকার সম্পন্ন হয়।
এদিকে তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও মৃত্যুর কারণ নিয়ে জনগুঞ্জণ ক্রমশ ভারি হচ্ছে। কেউ কেউ তার মৃত্যুর পেছনে প্রায় আড়াই মাস আগে হারপিক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা এবং ঐসময়ে তার ভালভাবে ওয়াশ না হওয়ায় শারীরীক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ ও এক পর্যায়ে অসুস্থতাজণিত কারণে তার মৃত্যু হয় বলে মনে করছে।
তবে মূল প্রশ্ন- আড়াই মাস পূর্বে হারপিক পানে আত্মহত্যা কেন করতে চেয়েছিল সে? একই আশ্রায়নে বসবাসকারী তৃতীয় লীঙ্গের অন্যান্যরা জানান, স্থানীয় এক যুবকের সাথে অসম প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিল সে। তবে কে সেই যুবক? সময়ে-অসময়ে কপিলমুনির এক জুয়েলার্সে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার। বিভিন্ন সময় সেখানে সময় কাটাতে দেখা যেত তাকে।
সূত্র বলছে, শুক্রবার বন্ধের দিনেও ঐ জুয়েলার্সের শার্টার টেনে ভেতর ঘন্টার পর ঘন্টা অবস্থান করতো তারা।কখনো কখনো চন্দনাকে ঐ জুয়েলার্সের ভেতর অবস্থানকালে কান্না করতে দেখা যেত! বিষয়টি সত্য হলে কি সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে? তবে কি আড়াই মাস আগে হারপিক পানে আত্মহত্যা প্রচেষ্টার জন্ম সেখান থেকে? আর যদি তাই হয়, তাহলে কিসের সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কপিলমুনি সদরসহ প্রত্যন্ত এলাকার জনমনে।
একসাথে পাশাপাশি ঘরে বসবাসকারী গুরু মা’ জুই জানান, স্থানীয় এক যুবকের সাথে ফোনে কথা হতো চন্দনার। এরআগে হারপিক পান করলে ব্যাপক চেষ্টা তদ্বিরের পর চন্দনা সুস্থ্য হলেও ঘঠনার কিছুদিন পর থেকে তার পায়খানা-বমির সাথে রক্ত আসছিল। তবে কি ঐ ঘটনার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় নতুন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল সে?
জুই আরো জানান, ঘটনার রাতে রাত আনুমানিক ৯টার দিকে তারা এক সাথে কপিলমুনি বাজার থেকে ঘরে ফেরে। ঐ সময় সে স্বাভাবিক ছিল। এর কিছুক্ষণ পর থেকে বাসায় বমি করতে থাকে। এসময় স্থানীয় জনৈক ডাক্তার মাহমুদুল্লাহকে আনা হলে তাকে অন্যত্র নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে চলে যান তিনি। এর কিছুক্ষণ পর মৃত্যু হয় তার।
মৃত চন্দনা কপিলমুনির গোলাবাটি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা। তার বাবা কয়রা উপজেলার চান্নিরচক বউ বাজার এলাকার আনন্দ ম-ল। প্রায় বছর খানেক আগে চন্দনা প্রকল্পের এই ঘরে ওঠে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এর আগে (তৃতীয় লীঙ্গ) মারুফা নামে আরেকজনের নামে ঘরটি বরাদ্দ হয়। সে চলে যাওয়ার পর মূলত চন্দনা এখানকার বিশেষ করে ঐ ঘরে বসবাস শুরু করে।
স্থানীয়রা জানান, চন্দনা ছাড়াও গোলাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২ জন হিজড়া সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। গুরুমা জুঁইয়ের তত্ত্বাবধানে চন্দনা সেখানে বসবাস করলেও লাবনী নামে আরো একজন রয়েছেন সেখানে।
গুরুমা আরও বলেন, ‘গত ১০-১২ দিন আগে তার (চন্দনা) পায়খানা ও বমির সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়। এরপর তাকে কপিলমুনি হাসপাতালে নিয়ে রক্ত, প্রস্রাব পরীক্ষা করাসহ বেশ কিছু পরীক্ষা হয়। তাতে প্রস্রাবে বেশি সমস্যা পাওয়া যায়। তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে তার অনিয়ম ছিল। চন্দনা জানে সে নিজে কী, তাই কোনও সম্পর্কের কারণে সে হারপিক খায়নি। মানসিক অস্থিরতা থেকে সে হারপিক খেয়েছিল।’
হরিঢালী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন বলেন, ‘খবর পেয়ে ২৪ নভেম্বর আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে চন্দনার লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য লাশ খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিকে নিয়ে ময়নাতদন্ত করানো হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। তারা তাকে কয়রার বাড়িতে নিয়ে যায়।’
পাইকগাছা থানার তদন্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) তুষার কান্তি দাশ বলেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্য চন্দনার মৃত্যুর খবর সেখানে যাই। তার সম্প্রদায়ের আরও লোকজন সেখানে ছিল।
তাদের তথ্য ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চন্দনা প্রায় ৩ মাস আগে হারপিক পান করে। এরপর তাকে কপিলমুনি ও সাতক্ষীরায় চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু সেসময় ওয়াশ করানো সম্ভব হয়নি। তাই চিকিৎসায় তার অবস্থার উন্নতি হলেও শারীরিক সমস্যা ছিল। গত এক সপ্তাহ ধরে তার পায়খানায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। ঘটনার রাতে বমি হয়ে অসুস্থ হওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। আমরা ধারণা করছি, হারপিক পানের পর ওয়াশ না হওয়ায় তার প্রতিক্রিয়া থেকে এমন হতে পারে। তাই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘হারপিক পানে নাড়িতে ক্ষত সৃষ্টি হয়। যা সঠিকভাবে ওয়াশ হওয়াটা জরুরি। কিন্তু সেটা না হলে ক্ষতস্থানে আলসার থেকে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য ময়নাতদন্তে জানা সম্ভব।’

Discussion about this post