এনামুল হক, কুষ্টিয়া: শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ার পরও ১৩ বছর ধরে চাকরিতে বহাল রয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালী সরকারি পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখার সহকারী শিক্ষক পলি রাণী পাত্র।
জাল সনদে চাকুরী করার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর মো. মফিজ উদ্দীন আহমদ ভূইয়া ও উপপরিচালক এস এম কামরুজ্জামানকে নিয়ে গঠিত দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ২০১৪ সালের ৩ মার্চ তারিখে পলি রাণী পাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে লিখিত ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।
সনদ জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেমকে মামলার নির্দেশ দিলেও আজ অবধি মামলা করা হয়নি।
ডিআইএ তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ভোকেশনাল শাখার ভাষা ইংরেজি শিক্ষক পলি রাণী পাত্র ২০১১ সালে ২ এপ্রিল বেসরকারি আমলে কুমারখালী পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ঐ বছরই ২৬ এপ্রিল সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেম কর্তৃক স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র সহ অন্যান্য সকল কাগজপত্র এমপিওভুক্তির জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারের অগ্রায়নপত্র নিয়ে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে ২০৪১/১ নম্বর স্মারকে প্রেরণ করেন।
প্রধান শিক্ষকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা অফিসার কর্তৃক এমপিওভুক্তির জন্য প্রেরিত কাগজপত্রে ভোকেশনাল শাখার ভাষা ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে পলি রাণী পাত্রকে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোকেশনাল শাখার শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিওভুক্তিকরণের জন্য কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সরবরাহ তথ্য ছকের (ক) ব্যক্তিগত তথ্য ছকের ৯ নম্বর কলামে নিবন্ধন সনদ বিষয়ে ইংরেজিতে নিবন্ধিত হওয়ার কথা পলি রাণী পাত্র উল্লেখ করেন, যার সনদ নম্বর ২১৭৪ এবং পাশের সাল ২০০৭। এমপিওভুক্তির কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি ও কুমারখালী পৌরসভার সাবেক মেয়র মো: সামছুজ্জামান অরুন, প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেম ও অভিযুক্ত পলি রাণী পাত্র। কিন্তু অভিযুক্ত পলি রাণী পাত্রের ইংরেজি শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ভুয়া বলে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পলি রাণী পাত্রের ইংরেজি শিক্ষক নিবন্ধন সনদ যাচাই বাছাই করা হয়। যাচাই পত্রের বেশিনিক/প. মু.প্রা./পরীক্ষা-৩/সনদ যাচাই/৩৫৩/১০/৫৮৮, তারিখ স্মারক ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ খ্রিস্টাব্দ। নাম-পলি রাণী পাত্র, পিতা-নিমাই চন্দ্র পাত্র, পদবি- সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), রোল নম্বর ১১০৬০৯৮০, নিবন্ধন নম্বর ৭০০২৯৬৫/২০০৭। সনদটি সঠিক নয় বলে এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ জানায়।
পলি রাণী পাত্র কর্তৃক জাল জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার বিষয়ে সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেমকে জানানো হয় এবং অনুলিপি জেলা প্রশাসক কুষ্টিয়া, জেলা শিক্ষা অফিসার কুষ্টিয়া ও অফিসার ইনচার্জ, কুমারখালী থানাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করা হয়।
এনটিআরসিএ থেকে পাঠানো পলি রাণী পাত্রের ইংরেজি নিবন্ধন সনদ সঠিক নয় এমন চিঠি কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রাপ্তির পর তদন্ত করে ১৫/০১/২০১৩ তারিখে ২২৭ নং স্মারকে সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেমকে বাদী হয়ে পলি রাণী পাত্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার পরামর্শ দেন।
সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহা. আবুল কাশেম ১৭/০১/২০১৩ তারিখে কুমারখালী থানা থেকে মামলার নথি বুঝে নিলেও অদ্যাবধি অদৃশ্য ক্ষমতার বলে মামলা করা হয়নি। মামলা না করে বরং পলি রাণী পাত্রকে ২০১৩ সালে জুন মাসে অবৈধ ভাবে ইংরেজি শিক্ষকের পরিবর্তে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কারিগরি অধিদপ্তর থেকে এমপিওভুক্তি করেছিলেন। যার ইনডেক্স নম্বর ছিল ১৩১৬০০০৮, বিষয়- বাংলা, এমপিও কোড-১০, বেতন স্কেল ৮০০০ টাকা, পদবি সহকারী শিক্ষক। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর হতে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে পলি রাণী পাত্রের এমপিওভুক্তির বিষয়টি ফাঁস হলে অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, পলি রাণী পাত্র ৬ মাস এমপিওর টাকা উত্তোলন করার পর বাংলাদেশ কারিগরি অধিদপ্তর থেকে তদন্ত করলে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভুক্তির বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। অক্টোবর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ কারিগরি অধিদপ্তর তার শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জালিয়াতির কারণে এমপিও বাতিল করে দেয়। এমপিও বাতিল হওয়ার পর তিনি ১০ বছর কোনো সরকারি টাকা পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক জানান, স্বীকৃত সনদ জালিয়াতি কিভাবে সরকারিকরণ হলেন? বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম অবসরে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সন্তোষ কুমার মোদক জাল রেকর্ডপত্র ও তথ্য গোপন করে পলি রাণী পাত্রকে ইংরেজি শিক্ষকের পরিবর্তে বাংলা শিক্ষক হিসেবে সরকারিকরণ করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ৩৭.০০.০০০০.০৯২.১৫.২২১.২১.৮৪০ নম্বর স্মারকে ০৬ নং ক্রমিকে পলি রাণী পাত্রকে সহকারী শিক্ষক বাংলা পদে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদানপূর্বক পদায়ন করা হয়েছে। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে প্রণীত মার্চ/২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক ইংরেজি/বাংলা বিষয়ে নিয়োগ পেতে হলে তক পর্যায়ে অবশ্যই ৩০০ নম্বরের বাংলা/ইংরেজি থাকতে হবে। কুমারখালী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, পলি রাণী পাত্রের স্নাতক পর্যায়ে ৩০০ নম্বরের বাংলা/ ইংরেজি নেই। তিনি সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ নিয়েছেন। প্রতারণা ও সনদ জালিয়াতি একটি ফৌজদারি অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয় থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। একজন সনদ জালিয়াতি কিভাবে শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে বহাল থাকেন তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সন্তোষ কুমার মোদকের কাছে পলি রাণী পাত্রের ইংরেজি জাল শিক্ষক নিবন্ধন সনদ নিয়ে চাকরি করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবকিছু নিয়ম মাফিক হয়েছে। সে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হলেও পরবর্তীতে তাকে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেখানো হয়েছে।
অভিযুক্ত পলি রাণী পাত্রের নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, ১০ বছর এমপিও না পাইলেও আমি বিধি মোতাবেক সরকারিকরণ হয়েছি আমার নিবন্ধন সনদে কোনো সমস্যা নেই। কুমারখালী সরকারি পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ, বি.এড সনদ, অ্যাকাডেমিক সনদ ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সনদ জাল বলে অভিযোগ রয়েছে।
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](http://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post