কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
তিন ফসলী জমির জেলা কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর কৃষি জমিকে গ্রাস করে বিষবৃক্ষ তামাক চাষে।
ফলে এই মৌসুমে প্রায় ২ লক্ষ মে:টন খাদ্যসশ্য
উৎপাদন ব্যাহতের সাথে পরিবেশ, মাটি ও জনস্বাস্থ্য দুষণের যে আর্থিক ক্ষতি হয় তা এখাত থেকে প্রাপ্ত সরকারের রাজস্বের তুলনায় শতগুন বেশি।
বিএটি সহ ৬টি তামাক কোম্পানী নানা কায়দা কানুনে প্রলোভনের জালে আটকে জেলার প্রায় ২৫
হাজার কৃষকদের তামাক চাষে বাধ্য করে থাকে। প্রায় ৬দশক ধরে কোম্পানীগুলি তামাক চাষকে নগদে অধিক লাভের প্রলোভন দেখিয়ে চাষীদের মজ্জায় ঢুকিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথচ তামাক চাষকে অলাভ জনক, মাটি দুষণ ও স্বাস্থ্যহানির কারন জেনেও চাষীরা আটকে আছে নগদ টাকার প্রলোভন বৃত্তে। সে কারনে তামাক
চাষের ঘুর্নিপাক থেকে চাষীদের মুক্ত করে বিকল্প ও অধিক লাভের ফসল আবাদে সরকারের কৃষি বিভাগ নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যাশোর অঞ্চলের টেকসই
কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে চাষীদের প্রশিক্ষন ও পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক প্রনোদনার মাধ্যমে উচ্চমূল্যের বিকল্প ফসল উৎপাদনে আগ্রহী করে
তুলছে চাষীদের। তারই একটি সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন মিরপুর উপজেলার পেপে চাষী জামিরুল ইসলাম। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে, পেপে, বস্তায় আদা চাষ,
ক্যাপসিকাম, গ্রীষ্মকালিন পিঁয়াজ ও তরমুজ, ড্রাগনসহ নানা জাতের উচ্চমূল্যের বিকল্প ফসল উৎপাদন করে চাষীরা এক বিঘা জমিতে তামাক চাষ থেকে যে
টাকা আয় করবেন তার চেয়ে নূন্যতম চারগুন বেশি আর্থিক লাভের নগদে উদাহরণ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন চাষীরা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মশান গ্রামের চাষী জামিরুল ইসলাম জানায়, ‘প্রায় ৬ মাস ধরে বাড়ির বউ ছাওয়াল পাল মিলে লাগাতার খাটাখাটনি কইরি, ৪০ তেকে ৫০
হাজার টাকা খারচ কইরি যে তামাক হয় তা বেচি (বিক্রয়) ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টেকা পাই। পরিবারের সবাই মিলে রাইত দিন তামুক পুড়াতি যাইয়ি ঘুম হয়না,
তামুকের গ্যাসে রোগ বালাই লাগিই আছে, ওই সময় স্কুল কলেজে পড়া ছেলি
মেয়েরা পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজ করতি হয়। জীবন শ্যাষ হয়ে যায় তামুক চাষ করতি গেলি। কৃষি বিভাগের অফিসাররা আমাক বুল্লি টেলিং(ট্রেইনিং) লিতি।
সেখান থেকি হাতে কলমে টেলিং লিয়ে উনাদের পরামর্শে পেপির বেছন (বীজ) লিয়ে এক বিঘি ভুঁইয়ে প্রায় সাড়ে ৪শ চারা লাগায়ছিলাম গত জানুয়ারি মাসে। এতে খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। রবিবার প্রথম চালানে পেপি ভাঙিচি,
প্রতিকেজি ১৫ টাকা কইরি বেচি এক লাখ ৭ হাজার টাকা বেচিছি, ব্যাপারিরা
আমার বাগানে আইনি লিয়ে গেছে, আমার কোন খরচ নেই’।
উপজেলার বলিদাপড়া গ্রামের অপর কৃষক মহিদুল ইসলাম জানায়, ‘জীবন ভর আমরা
চাষীরা যা করতি যায় তাতেই ঠকি, না জানার কারনে বুঝতে পারিনা কোনটা
সঠিক। ক্ষতিকর, লোকসান এবং স্বাস্থ্যহানি জেনেও শুধুমাত্র বিক্রী করে একসাথে
নগদ টাকা পাওয়া যায় সে কারনে ছাষীরা আটকে আছে তামাক চাষে। অথচ এই যে
দ্যাখেন আমার ২৫ কাঠা জমিতে পেঁপে চাষ করে ৬ মাসের মথ্যে আমার গাছের
দিকে তাকালে মন ভরি যায়। প্রতিটা গাছে এগুলি পেপে না টাকা ধরে আছে।
এখানে লুকোচুরির কিছু নেই ওপেন দেখতে পাচ্ছেন প্রতিটা গাছে কি
পরিমান পেপে ধরেছে। এখন শুধু বলবো পেপে বেচার কথা। ব্যাপারিরা মাঠে এসে
নিয়ে যাবে। অথচ গত বছর পর্যন্তও আমি নগদ টাকার জন্য তামাক চাষ করিছি যা একবারই টাকা পেয়েছি, কিন্তু আমার মাঠের এই পেপি বেচপো(বিক্রী) দুই বছর
পর্যন্ত। এসময় যে টাকার পেপি বেচপো তা তামাকের চেয়ে ৪গুন টাকা পাবো’।
কুষ্টিয়া শহরের নিশান মোড়ের সব্জি বিক্রেতা নিত্যরঞ্জন বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে
মানুষের প্যাটের গ্যাষ্ট্রিকসহ নানা রোগ বেড়ে গেছে বলে পেপের চাহিদাও বেড়ে
গেছে’। আমার দোকানেই প্রতিদিন প্রায় একমণ পেপে কেজি প্রতি ২৫ থেকে
৩০টাকা বিক্রী করি।
মিরপুর উপজেলার মাঠকর্মী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুল ইসলাম জানান, ‘উচ্চমূল্যের বিকল্প ফসল পেপে চাষের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিক মুনাফার
সাফল্য দেখে ইতোমধ্যে আরও অন্যান্য তামাক চাষীরাও আগ্রহী হয়ে উঠছে পেপে
চাষে। আমরা চাষীদের প্রশিক্ষনসহ নানাবিধ সরকারী প্রনোদনাসহ পরামর্শ দিয়ে
চাষীদের পেপেসহ আরও অন্যান্য উচ্ছমুলের ফসল আবাদে আগ্রহী করে তোলার
মাধ্যমে বিষবৃক্ষ তামাক চাষ থেকে চাষীদের রক্ষা করা সম্ভব হবে’।
প্রকল্প পরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন,‘কৃষিকে লাভজনক ও বানিজ্যিক ভিত্তিতে
গড়ে তুলতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষনের
মাধ্যমে চাষীদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে সরকার নানা কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে।
সেগুলি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প
কাজ করে যাচ্ছে।

Discussion about this post