বর্ষাকাল হচ্ছে খাসিয়া পান উৎপাদনের ভরা মৌসুম। সাধারণত একটি পানগাছে
অন্য সময়ে যে পরিমাণ পান তোলা হয়, বর্ষা মৌসুমে তার দ্বিগুণ পান তোলা
হয়। কিন্তু এ বছর খরার প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পান উৎপাদন
প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। যা পাওয়া যাচ্ছে তাও আকারে ছোট।
জানা যায়, অনাবৃষ্টির কারণে পানের উৎপাদন অন্য স্বাভাবিক সময়ের চাইতে কম।
এতে পান চাষের ওপর নির্ভরশীল খাসিয়া পানপুঞ্জির (আদিবাসী গ্রাম) ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাসিন্দারা কপালে হাত।
আদিবাসী সংগঠন খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল ও পুঞ্জি সূত্রের বরাতে জানা গেছে,
অন্য সময় একটি পানজুম থেকে প্রতিদিন তিন কুড়ি পান তোলা গেলেও জুন থেকে
আগস্টে ভরা মৌসুমে পাঁচ কুড়ি পান তোলা যায়। ২০ কান্তায় এক কুড়ি। এক
কান্তায় ১৪৪টি পান থাকে। এবার ভরা মৌসুমে পানের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে
এসেছে। এদিকে এবার এক কুড়ি পানের (২৮৮০টি পান) দাম অন্য বছরের মতোই ৮০০
টাকা থেকে এক হাজার টাকা। কিন্তু দাম থাকলেও পান উৎপাদন কম হওয়ায় চাষীরা
দু:চিন্তায়।
মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ছোট-বড় ৭৩টি খাসিয়া পুঞ্জি আছে।
এসব পুঞ্জিতে আদিবাসী খাসি (খাসিয়া) লোকজন বসবাস করেন। বৃহত্তর সিলেটে
আছে মোট ৮৩টি পুঞ্জি। ৮৩টি পুঞ্জিতে প্রায় ৩০ হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর
লোকজনের বাস। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে খাসিয়া
পানচাষে।
খাসিয়া পানচাষিরা বলেন, পাহাড়ি টিলাভূমিতে পর্যাপ্ত সেচসুবিধা নেই। এই
পান চাষ পুরোটাই প্রকৃতি-নির্ভর। মৌসুমী বৃষ্টির ওপর চাষীদের নির্ভর করতে
হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তাঁদের। বৃষ্টি
না হলে পান উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়ে। এ বছর খাসিয়া পান উৎপাদন অনাবৃষ্টির
কবলে পড়েছে। দীর্ঘ খরার কারণে সময়মতো পানগাছের পরিচর্যা করা সম্ভব হয়নি।
পানগাছ পরিচর্যার সময় হচ্ছে জুন থেকে আগস্ট মাস। এই সময়ে পান উৎপাদনের
ভরা মৌসুম। অনেক দেরিতে বৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পান উৎপাদনে।
চক্রাকারে একটি পান গাছ থেকে এক থেকে দেড় মাস পরপর একবার পান তোলা যেতো।
এবার সেটা সম্ভব হচ্ছে না। একটি পানগাছ থেকে পান তুলতে দুই থেকে আড়াই মাস
পর্যন্ত বিরতি দিতে হবে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পানের উৎপাদন কম হচ্ছে।
পানচাষিরা আরও বলেন, শুধু পান উৎপাদনই কমেনি, পানপাতার আকারও ছোট হচ্ছে।
পানের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাঁধা। বাজারে বড় পানের চাহিদা বেশি। বড় পান
হলে দাম ও পাওয়া যেত, ছোট পানে সেই দাম পাওয়া যায় না।
উপজেলার লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির পানচাষি শামিম পামথেত বলেন, খরার কারণে
সঠিক সময়ে গাছে পান আসেনি। এখন পানের ভরা মৌসুম। এখনো বৃষ্টি খুবই কম
হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে পুরোপুরি পান তোলা যায় না, পরিচর্যা করা যায় না।
আরেক পানচাষি জেসি পতমী বলেন, পানগাছ থেকে নতুন চারা কাটাকে বলা হয় ‘বুট
টাং’। এবার খুব কমই চারা কাটা হচ্ছে। এখন গাছ পরিচর্যার মৌসুম। এ মৌসুমে
একটি পানজুমে (পানখেত) প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিকের
খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়ছে। যেসব গাছ রোগাক্রান্ত হয় বা মরে যায়, সেগুলো
পাল্টে পুন:রায় চারা লাগানো হয়। এবার অনেক জুমেই চারা রোপণ করা হচ্ছে না।
এতে আগামী মৌসুমেও পান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। গত বছর ভরা মৌসুমে
খাসিয়া পানের বৃহৎ বাজার সিলেট ও সুনামগঞ্জে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়েছিল।
বন্যার কারণে পানের চাহিদা কমে যায়। পানের প্রকৃত দাম পাননি পানচাষিরা।
এবার খরায় পান উৎপাদন কমেছে। ধারাবাহিক আর্থিক লোকসানে রয়েছেন খাসিয়া
পানচাষিরা। এ ক্ষেত্রে সরকার থেকে খাসিয়া পানচাষিদের স্বল্প সুদে ঋণ
দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এই চাষিরা।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়া পুঞ্জির মান্ত্রী
(সমাজপ্রধান) জিডিশন প্রধান সুছিয়াং বলেন, পানচাষ খুব সতর্কভাবে ও যত্ন
নিয়ে করতে হয়। অনাবৃষ্টিতে পান পরিচর্যায় দেরি হয়ে গেছে। এতে পানের
উৎপাদন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। খাসিয়ারা পানের ওপরই নির্ভর করে
থাকেন। পান উৎপাদন কম হওয়ায় কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার একটু
সুদৃষ্টি দিলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ/