রফিকুল্লাহ্ কালবী: যারা পরীক্ষার্থী তারাই প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।
এমনকি পরীক্ষায় পাসও করেছেন—এমন অভিযোগ উঠেছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে।
অভিযোগে বলা হয় মশিউর রহমান ও মাজহারুল ইসলাম নামের দুই পরীক্ষার্থী আগের রাতে প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন। ফলে ওই সময়ই তারা পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে যান।
পরদিন হলে গিয়ে তারা পরীক্ষা দেন এবং যথারীতি পাস করেন। এছাড়া পরীক্ষায় অংশ নেননি এমন আরও কয়েক জনের নামও না কি রেজাল্ট শিটে এসেছে। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজসহ আশেপাশে ব্যাপক কানাঘুষা চলছে।
জানা গেছে, মশিউর রহমান, মাজহারুল ইসলাম ও পপি খাতুন এই তিন জন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাস্টাররোলে চাকরি করেন। নিয়োগ পরীক্ষার রেজাল্ট শিটে অন্যান্যের সঙ্গে তাদের নামও এসেছে। এই তিন জনের নিয়োগ নিশ্চিত করতেই প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়া এবং হলে উত্তর লেখায় সহযোগিতার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের। দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র তৈরির সময় উপস্থিত ওই দুই পরীক্ষার্থী পরের দিন সকালে সেই প্রশ্নপত্র নিয়ে অধ্যক্ষর সঙ্গে পরীক্ষার হলে যান। এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজও হাতে এসেছে। তবে ওই ফুটেজে আরেক অভিযুক্ত পপি খাতুন ছিলেন না। পপি খাতুনকে পরীক্ষার হলে একজন নারী ডাক্তার উত্তর লিখতে সহযোগিতা করেছেন বলে পরীক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন।
গত ২৭ মে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের আটটি পদে ১৫ জনের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগ উঠেছে, তিন জন নিয়োগপ্রার্থী বর্তমান মেডিকেল কলেজে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কম্পিউটার কাম অফিস সহকারী পদে কাজ করছেন। এদের মধ্যে দুই পুরুষ প্রার্থী পরীক্ষার আগের দিন রাতে এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি থেকে শুরু করে সেগুলো প্যাকেট করা পর্যন্ত তারা নিয়োজিত ছিলেন। অভিযোগ, সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ দেলদার হোসেন জেনেশুনেই তাদের এই নিয়োগ পরীক্ষার কাজে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। যা তাদের পরীক্ষায় পাস করানোর দুরভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ।’ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের একজন কর্মচারী বলেন, ‘মেডিকেল কলেজের মূল ভবনে ক্যাম্পাস স্থানান্তরের ফলে দাফতরিক বিভিন্ন কাজের জন্য লোকবল প্রয়োজন হয়। ফলে আটটি পদের জন্য ১৫ জনের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক শুক্রবার (২৭ মে) নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়া শহরের সরকারি মহিলা কলেজ ও কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অন্য পদের পরীক্ষাগুলো হয়।’
জানা যায়, হিসাবরক্ষক পদে এক জন, স্টোর কিপার এক জন, লাইব্রেরিয়ান এক জন, ড্রাইভার দুই জন, ল্যাব এটেন্ডেন্ট চার জন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেট পদে চার জন, অডিও ফিজিওলজি অপারেটর এক জন ও প্রধান সহকারী পদে এক জনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পদগুলোর বিপরীতে পরীক্ষার্থী ছিলেন ২৯০০ জন। অভিযোগ উঠেছে- মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বর্তমানে কর্মরত মশিউর রহমান ও মাজহারুল ইসলামকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কম্পোজ ও পরীক্ষার শেষে খাতা দেখার কাজে সম্পৃক্ত রাখে। এই বিষয়টি সম্পর্কে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টরা অবগত রয়েছেন।
নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এক পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক দেশতথ্যকে বলেন, ‘যারা পাস করেছে তাদের অনেকেই পরীক্ষায় অংশ নেননি। তারপরও তাদের রোল রেজাল্টশিটে এসেছে।’ আরেক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘পরীক্ষার্থী পপি খাতুন, মশিউর রহমান ও মাজহারুল ইসলাম ২০১৯ সাল থেকে কলেজে মাস্টার রোলে চাকরি করছেন। এর মধ্যে পপি খাতুনকে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মুসতামজিদ চাকরি দেন। পরীক্ষায় এই তিনজনই পাস করেছেন।’
অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, ১৫টি পদের বিপরীতে দুই হাজার ৯০০ জনের নিকট থেকে ১৬০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। সব ক’টি পদের বিপরীতে প্রার্থী যদি আগেই ঠিক করে রাখে কর্তৃপক্ষ তাহলে এত ফরম বিক্রির কী দরকার ছিল? এখানে চরম অনিয়ম হয়েছে। মেধায় নিয়োগ না দিয়ে যে অনিয়ম করা হয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে এই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার আহবান জানান সাধারণ পরীক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত মাজহারুল ইসলাম, মশিউর রহমান এবং পপি খাতুনকে ফোন করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার বিষয়ে জানতে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ দেলদার হোসেনকে ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি তার ফোনে ম্যাসেজ দিয়েও উত্তর মেলেনি। এরপর বেশ কয়েকবার তার দফতরে গেলেও সাক্ষাতের অনুমতি মেলেনি। তবে কলেজের একজন কর্মকর্তা জানান, পরীক্ষার্থীকে দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করার ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর অধ্যক্ষ নানাভাবে সবাইকে এড়িয়ে চলছেন। কাউকে সাক্ষাৎও দিচ্ছেন না। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষর কার্যালয়ের বাইরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, কাকে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা। আরও অনেক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। এ রকম ঘটনা যে ঘটেছে তা হাসপাতালের অধিকাংশ স্টাফই জানেন।
গতকাল শুক্রবার বিতর্কিত লিখিত পরীক্ষায় যদের পাশ দেখানো হয়েছে তাদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এসময় মেডিকেল কলেজে ভুক্তভোগী চাকরিপ্রার্থীগণ উপস্থিত হয়ে মৌখিক পরীক্ষা না নেয়ার জন্য অনুরোধ করলে অধ্যক্ষ ডাঃ দেলদার হোসেন তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি ভাইভা গ্রহণ করবেন বলে জানান। পরে অভোযোগকারী প্রার্থীগণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন।

Discussion about this post