Print Date & Time : 2 August 2025 Saturday 4:17 pm

অবৈধ ফিটনেস বিহীন গাড়ী, দুর্ঘটনায় ৮ হত্যার দায় কার?

হাসান আলী, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:
ট্রাক-মাইক্রো মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মাইক্রো বাস ঢাকা মেট্রো: -চ-১৩-৯৭৯২’র যাত্রী একই পরিবারের ৭জন এবং মাইক্রো চালকসহ ঘটনাস্থলেই ৮জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে মাইক্রো
বাসটির ত্রুটি এবং অদক্ষ চালকসহ এসব দেখভালে সংশ্লিষ্ট বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বহীনতাকে দুষছেন।

তাদের অভিযোগ টাকার বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির ছাড়পত্র এবং অদক্ষ চালকের হাতে লাইসেন্স তুলে দিয়ে দুর্ঘটনার নামে কার্যত: মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।
এমন অভিযোগের তথ্যানুসন্ধানে উঠে আসা চিত্রের ভয়াবহতা আরও শতগুন বেশি। মাদক, স্বর্ণ ও অস্ত্রসহ উচ্চমূল্যের চোরাচালানী মালামাল পরিবহনে ব্যবহারকালে
বিভিন্ন সময় আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক অথবা আন্ত:জেলা গাড়ী চোর চক্রের কাছ থেকে জব্দকৃত গাড়ীগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন শৃংখলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তারা আত্মসাত করেন বলে অভিযোগ আছে।

তারা জব্দকৃত মালামাল আদালতে সৌপর্দ করলেও গাড়ীগুলি ছেড়ে দেয়ার মতো আইনের ফাঁকে কার্যত: নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। কিছুদিন পর্যন্ত ওইসব গাড়ীগুলি গোপনীয়
কোথাও রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট ইস্যু স্বাভাবিক হয়ে আসলেই গাড়ীগুলিকে নানাভাবে ঘসামাজা করে আবার সেটা রাস্তায় বের করে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এজাতীয় গাড়ীগুলি বে-আইনী কাজে ব্যবহারকালীন সময়ে জব্দ হওয়ায় গাড়ীগুলির প্রকৃত
মালিক ভোগান্তি ও হয়রানি থেকে নিজেদের গা বাঁচাতে পরিচয় গোপন করে যান এবং গাড়িটির মালিকানা অস্বীকার করেন।
এমন অবস্থায় আইনের ফাঁক গলিয়ে বিআরটিএ’র যোগসাজসে ট্যাক্স টোকেন আপডেট করে স্বয়ং আইন শৃংখলা বাহিনীর কর্তা বাবুরা সহজেই আত্মসাতের কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হন বলে তথ্য উঠে এসেছে। এভাবেই অবৈধ ফিটনেস বিহীন পুরাতন ত্রুটিপূর্ন গাড়ি আবার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ পায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রানহানির কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন তথ্যই উঠে এসেছে সম্প্রতি নাটরের বনপাড়া মহাসড়কে মাইক্রো-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ৭জন যাত্রী ও চালকসহ ৮জনের প্রানহানির মধ্যে দিয়ে।

এঘটনায় দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ গ্রামের বাসিন্দা নিহত আনোয়ারা খাতুন(৫০)র স্ত্রী হারা শোকার্ত স্বামী শহিদুল ইসলাম বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন-‘আপনারা শুধুমাত্র দুর্ঘটনায় প্রাণহানির
সংবাদ প্রচার করেই শেষ করেন। কেনো এই দুর্ঘটনা ঘটলো ? কার দায়িত্বহীনতা বা অনিয়ম দূর্নীতির পথ ধরে ত্রুটিপূর্ন ফিটনেস বিহীন গাড়ীকে ফিটনেস দেখিয়ে ট্যাক্স টোকেন আপডেট করা এবং মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অদক্ষ
চালকদের হাতে লাইসেন্স তুলে দিয়ে প্রাণ হানির জন্য দায়ি কারা তাদের কাছে জানতে চান এই মর্মান্তিক প্রাণহানির দায় কার ?’

সরকারী ভাবে এসব দেখার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত রয়েছে তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমান নাকি সবকিছু জেনে শুনেই ঘুমের ভান করেন? হাইওয়ে পুলিশ, থানা পুলিশ, বিআরটিএ সহ এসব বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তারা আজ পর্যন্ত কোন একটি প্রাণহানিরমদুর্ঘটনার কোন কারন জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন ? আমি এটাকে নিছক দুর্ঘটনা না বলে বরং দায়িত্বহীণদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ড বলতে চাই। এমন নির্মম ঘটনায় যেনো আর কারো জীবনে সর্বনাশ না হয়’। আমার পরিবারের
স্ত্রী, ভাই, বোন, ২ ভাইবৌ, নিহত ভাইয়ের শ্বাশুড়ি ও শালিকা এই ৭জনের মতো পরিনতি যেনো দেশে আর না ঘটে’।
দুর্ঘটানায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মাইক্রো বাস ঢাকা মেট্রো: ১৩-৯৭৯২’র চালক দৌলতপুর উপজেলার ধর্মদহ গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিনের ছেলে নিহত
সাহাব আলী(৪২)’র স্ত্রী আসমা খাতুন (৩০) বলেন, ‘৪ বছর পূর্বে আমার স্বামী গাড়ীটি এক পুলিশ অফিসার স্যারের কাছ থেকে ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে
কিনেছে। আগে গাড়ীটি ওই স্যার নিজেই চালাতেন। পরেও মাঝে মধ্যে পুলিশ স্যার এই গাড়ি চালিয়েছে। কাগজপাতি সবকিছু ঠিকঠাক আছে’। গাড়িরও কোন সমস্যা ছিলো না; গত সপ্তাহে যশোর থেকে নতুন ইঞ্জিন করে এনেছে’।
দুর্ঘটনার পর সাহাব আলীর লাশের সাথে গাড়ীর কোন কাগজপাতি বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নাটোরের পুলিশ ফিরিয়ে দেয়নি’।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ‘ঢাকা মেট্রো:
১৩-৯৭৯২ মাইক্রো বাসাটি ২০০৫ সালে তৈরি ১৮শ সিসি পেট্টোল চালিত ৮ সিটের যানবাহনটির ইঞ্জিন নং ৭ক-০৮০৫২০০। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নারায়নগঞ্জের মন্ডোলালপুরের বাসিন্দা আলহাজ নুর মহম্মদের স্ত্রী উম্মে কুলসুম জেড এইচ অটো থেকে ক্রয় করেন এবং ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারীতে বিআরটিএ কর্তৃক নিবন্ধনভুক্ত হন। অদ্যবধি মাইক্রোটির বৈধ মালিকানা উম্মে কুলসুমের নামেই বিদ্যমান এবং ২০২৬’র জুন পর্যন্ত ফিটনেস এবং ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত
ট্যাক্স টোকেন কার্যকর আছে। তবে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর ওসি আলম চাঁদ নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা কোন প্রকার বৈধ মালিকানা ছাড়াই নিজ নামে বায়োমেট্রিক্স করার আবেদন করেন। সেখানে এসএমএস প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত
মোবাইল নং ০১৭১১৩৭৭১২২ নম্বরটি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও বর্তমান উত্তরা থানায় পোষ্টিং দাবি করে ওসি আলম চাঁদ প্রতিবেদকের সাথে মুঠোফোনে আলাপকালে মোবাইল নম্বরটি তার নিজের বলে স্বীকার করলেও উল্লেখিত মাইক্রো বাসটির
মালিকানা তার নয় এবং তিনি এটি বিক্রয় করেননি বলে দবি করেন। যেখানে নিহত মাইক্রো চালক সাহাব আলীর স্ত্রী আসমা খাতুনের দাবি মাইক্রো বাসটি পুলিশ স্যারের নিকট থেকেই কিনেছেন।
সরেজমিন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়া দৌলতপুর উপজেলার বিস্তৃীর্ন এলাকার অজপাড়া গাঁয়ের বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়িতে যত্রতত্র অসংখ্য মাইক্রো ও
প্রাইভেট কার দেখা যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ এসব গাড়ীগুলি সব চোরাই পথে
আসা এবং কার্যত: অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই গাড়িগুলি আমদানি নিষিদ্ধ মাদক স্বর্ণ অস্ত্রসহ কালোবাজারি নানাবিধ উচ্চ মূল্যের মালামাল বহনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
সীমান্তরক্ষী বিজিবি ও হাইওয়ে পুলিশসহ আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অথবা কখনও তাদের সাথে গোপন চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে চোরাচালানী কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাদক বহনকারী এসব অবৈধ মাইক্রো বা কার ধরতে গিয়ে গত ১০ বছরে ৪ জন পুলিশ সদস্যসহ অসংখ্য মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে; কিন্তু কোন একটি ঘটনারও আজ অবধি কোন বিচার হয়নি।

এবিষয়টি জানতে চাইলে দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোলায়মান সেখ বলেন, ‘এটা ঠিক যে সড়ক দর্ঘটনায় কেউ নিহতের ঘটনায় স্বাভাবিক অর্থে নিহতের লাশ উদ্ধার বা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা পর্যন্তই
তৎপরতা থাকে। কিন্তু ঘটনাটা কিভাবে বা কেনো ঘটলো সেবিষয়ে আর কোন নেয়া হয়না। তবে যেহেতু এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে গাড়ী বা চালকের
বৈধ অবৈধ বা ন্যায্যতার প্রশ্নটি উঠে এসেছে; আমরা খুব শীঘ্রই এসব অবৈধ গাড়িগুলির কাগজপত্র চেক করে কোন অসঙ্গতি থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি
পদক্ষেপ নেয়া হবে’।

দৌলতপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হাই সিদ্দিকী বলেন, ‘সত্যিই সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটলেও এসব ঘটনা প্রসমনে যে কাজগুলি করা দরকার সেখানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আহত নিহতদের উদ্ধারসহ প্রয়োজনীয় কাজগুলি করে
থাকি। তবে দুর্ঘটনার এড়াতে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে
সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আইনী পদক্ষেপে কি কি ঘাটতি রয়েছে সেগুলি চিহ্নিত করেও
ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
উল্লেখ্য গত ২৩ জুলাই নাটোরের বড়াইগ্রামে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একই
পরিবারের ৭ জন এবং মাইক্রো চালকসহ ৮ জনের মৃত্যুকে ঘিরে নিহতদের পরিবারের
পক্ষ থেকে দাবি উঠে দুর্ঘটনা কবলিত মাইক্রো বাসটির ফিটনেস এবং অদক্ষ
চালকদের হাতে লাইসেন্স দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে কি না তা তদন্ত করতে হবে’।