Print Date & Time : 10 May 2025 Saturday 10:39 pm

আদমজী জুট মিল ও আদমজী ইপিজেডের প্রাসঙ্গিক কথা

আদমজী পরিবারের তিন ভাই ও গুল মোহাম্মদ ১৯৫০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে ২৯৪ দশমিক ৮৮ একর জমি নিয়ে আদমজী জুট মিলস নির্মাণ করেছিলেন।

নারায়ণগঞ্জের মহানগরের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে অবস্থিত এশিয়ার এক সময়ের বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল। যা বিগত ৩০শে জুন ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ২৪৫.১২একর এলাকার উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা আদমজী ইপিজেড (এইপিজেড) নামে নাম করন হয়। 

ইপিজেডে গত তিন বছর ধরে বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়লেও কমেছে শ্রমিকের সংখ্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু কারখানায় অসন্তোষ, অর্ডার কম থাকার কারণে শ্রমিক কমানো হয়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে এ ইপিজেডে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই বছরে ইপিজেড থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৯৩০  মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকরি করেছেন ৫০ হাজার ১৭২ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা।

লোকসানের অজুহাতে বন্ধ হয়ে যায় এশিয়ার বৃহত্তম জুট মিল:

জানা গেছে এশিয়ার একসময়ের বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিলসটির শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও আদমজী নগরবাসীর জন্য ৩০ জুন একটি বেদনাবিধুর দিন। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ যৌথভাবে ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৪ দশমিক ৮৮ একর জমি নিয়ে আদমজী জুট মিলস নির্মাণ করেন। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন শুরু হয়। তখন প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত আদমজী জুটমিলে প্রতিদিন গড়ে ২৮৮ টন পাটের চট উৎপাদন করা হতো।

তখন মিলে ৩ হাজার ৩০০টি তাঁতকল বসানো হয়। ওই সময় মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। আদমজীর চটের ব্যাগ ও বস্তার একটি অংশ অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। ৪ নাম্বার মিলে তৈরী উন্নতমানের ব্রডলুম, জিও নামে পাটজাত পন্য পুরোটাই বিদেশে রফতানি হতো। ৫ নং মিলে (এবিসি) তৈরী হতো লেমিনেটেড পলি ব্যাগ। ৬ নং মিলটি ছিল ওয়ার্কশপ। শুরুতে প্রায় ১০০ টন পাটজাত পন্য উৎপাদন হলেও ধীরে ধীরে তা বেড়ে আড়াই শ’ টনে উন্নীত হয়। মিলটি বন্ধের সময় ২৪ হাজার ৯১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক চাকুরি করতেন। 

স্বাধীনতার বছর কয়েক পর থেকে তথাকথিত শ্রমিক আন্দোলনের নামে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবন যায়। এসব কারনে মিলটি লোকসান গুনতে গুনতে ৩০শে জুন ২০০২ সালে তৎকালীন ৪দলীয় জোট সরকার মিলটি বন্ধ ঘোষণা করে শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ করে দেয়। এতে ২৪ হাজার ৯১৬ জন শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা চাকুরী হারায়।পরবর্তীতে সেখানে ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

আদমজীর পরে নারায়ণগঞ্জে বন্ধ হয়েছে আরো ১০টি পাটকল: এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার পরে নারায়ণগঞ্জে বন্ধ হয়েছে আরো অন্তত ১০টি পাটকল। বন্ধ হয়ে পড়া জুট মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত তাজ জুট প্যাকিং কোম্পানী, প্রাইম জুটেক্স, শীতলক্ষ্যার পূর্বতীরে সোনাকান্দার সারোয়ার জুট মিল, নবীগঞ্জে জামাল জুট মিল, উত্তর নদ্যার আমিন ব্রাদার্স জুট এন্ড কোঃ, কাঁচপুর এলাকায় আনোয়ার জুট মিল, এলাইড জুট মিল, রূপগঞ্জে তারাব এলাকায় নিশান জুট মিল, গাউছিয়া জুট মিল, মাসরিকী জুট মিল। যেগুলোর অনেকগুলোর অবকাঠামোও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অবকাঠামো থাকলেও বিক্রি করে দেয়া হয়েছে মেশিনারীজ। 

নারায়ণগঞ্জের পার্শবর্তী ডেমরা ও নরসিংদীতে ৪টি সরকারী পাটকল চালু থাকলেও নারায়ণগঞ্জে বেসরকারীভাবে ৪ টি পাটকল ও একটি স্পিনিং মিল চালু রয়েছে। তবে সেগুলোও ধুঁকছে নানা সমস্যায়। সরকারের বন্ধ কলকারখানা চালুকরণ নীতিমালার আওতায় বন্ধ আদমজী জুটমিলের ২নং ইউনিটের স্থানে ৫০ তাত বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক ডাইভারসিফাইড প্রোডাক্ট তৈরির মিল স্থাপন এবং মনোয়ারা জুট মিলকে টিস্যু পেপার মিলে রুপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে দীর্ঘদিনেও সে পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। চালু থাকা মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঁচপুর বাজার এলাকায় নওয়াব আব্দুল মালেক জুট মিল, রূপগঞ্জের তারাবোর টাটকী এলাকায় অবস্থিত নিউ ঢাকা জুট মিল, উত্তরা জুট মিল, কাঞ্চনে নবারুন জুট মিল।

 ৫ হাজার ডলারের অধিক পণ্য রফতানী, অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মচাঞ্চল্য: আদমজীর ঐতিহ্যবাহী ওই শ্রম জনপদে গড়ে ওঠা ইপিজেডে কয়েক বছরের ব্যবধানে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেতে শুরু করে। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ইপিজেডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও মাত্র ১৬২৫ জন শ্রমিক নিয়ে শুরু হয় ইপিজেডটির যাত্রা। বর্তমানে সেখানে কাজ করছে অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক কর্মচারী। এ ইপিজেডের মোট প্লটের সংখ্যা ২২৯টি।

বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ জোন (বেপজার) ওয়েবসাইট থেকে দৈনিক দেশতথ্যের প্রতিনিধি জেনেছেন, বর্তমানে এ ইপিজেডে ৪৮ টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে রয়েছে। যার মধ্যে ২০ টি বিদেশী, ৭ টি যৌথ মালিকানাধীন ও ১১ টি বাংলাদেশী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।

যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মরিশাস, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, হংকং, চীন, ভারত, ইউক্রেন, রোমানিয়া, কুয়েত, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া, ভার্জিন আইল্যান্ড, কানাডার মালিক। প্রতিটি প্লটের আয়তন ২ হাজার বর্গমিটার। কোন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান ১০ এর অধিকও প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। এসব কারখানায় গার্মেন্টস, জিপার, কার্টন, হ্যাঙ্গার, লেভেল, ট্যাগ, জুতা, সোয়েটার, টেক্সটাইল, মোজা, জুয়েলারী, পলি ও ডায়িংসহ ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। যা শতভাগ রফতানিযাগ্য পণ্য। আদমজী ইপিজেড প্রতিষ্ঠার পর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছিল মাত্র ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ ইপিজেডে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৪৭২  মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ইপিজেডে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ ইপিজেডে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ইপিজেডে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০০৬-০৭ অর্থবছরে বিদেশে রফতানি হয়েছিল মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইপিজেড থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৬৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইপিজেড থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪৮৪  মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইপিজেড থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২২৫  মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইপিজেড থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৯৩০  মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য।

২০০৫-০৬ অর্থবছরে কর্মসংস্থান হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৬২৫ জনের। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকুরী করেছেন ৫৮ হাজার ২১২ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকুরী করেছেন ৬২ হাজার ২০০ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকুরী করেছেন ৫৪ হাজার ৯২৩ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা। অর্থাৎ সর্বশেষ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকুরী হারিয়েছেন ৭ হাজার ২৭৭ জন শ্রমিক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইপিজেডে চাকরি করেছেন ৫০ হাজার ১৭২ জন শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা।

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুলাই ০২,২০২২//