দেড়শো বিঘা পৈত্রিক সম্পত্তির পুরোটাই বে-দখলে!
ওপেলিয়া কনি
বিশেষ প্রতিবেদক , কুষ্টিয়া// আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল ও বিস্ময়কর নাম বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জাপানি নেতাদের পক্ষে যুক্তিসম্মত রায় দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন। আজও জাপানে তাঁর নামে রাস্তা, জাদুঘর, বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রোঞ্জ নির্মিত মূর্তি রয়েছে। অথচ নিজের জন্মভূমি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কাকিলাদহ গ্রামে তাঁর পৈত্রিক ভিটে ও দেড়শো বিঘা জমির আজ কোনো অস্তিত্ব নেই—ভোগদখলে রয়েছে স্থানীয়দের, নেই কোনো সরকারি স্মারক, সাইনবোর্ড, পাঠাগার বা স্মৃতি জাদুঘর।
ড. পালের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া গ্রামের মাতুলালয়ে, যা স্থানীয়ভাবে ‘জজপাড়া’ নামে পরিচিত। পিতা ছিলেন বিপিন বিহারী পাল। শৈশবে শিক্ষালাভ করেন মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান গ্রামের পণ্ডিত গোলাম রহমানের কাছে। এরপর পড়াশোনা করেন তারাগুনিয়া এল.পি স্কুল (বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়), কুষ্টিয়া হাই স্কুল ও রাজশাহী কলেজে। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ও ১৯২৫ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন আনন্দমোহন কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। পরে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি (১৯৪১–৪৩) ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৪৪–৪৬)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে গঠিত টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে তিনি একমাত্র বিচারক যিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ‘বিজয়ীদের প্রতিশোধ’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন—এই বিচার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ করেনি।
তাঁর রচিত ৮০০ পৃষ্ঠার বিশ্লেষণধর্মী রায় আজও জাপানে ইতিহাস হয়ে আছে। এজন্য জাপান সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান “কোক্কা কুনশো” প্রদান করে এবং নিহোন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেয় সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি। ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করে পদ্মবিভূষণ পদক। টোকিও ও কিয়োটো শহরে রয়েছে তাঁর নামে রাস্তা, জাদুঘর ও মূর্তি। এমনকি ‘টোকিও ট্রায়াল’ নামে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সিরিজেও তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে, যেখানে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খান।
তবে কাকিলাদহ গ্রামে তাঁর পৈত্রিক ভিটা, বিশাল জলাশয় ও দেড়শো বিঘা জমির পুরোটাই স্থানীয় জনগণের ভোগদখলে। সেখানে চাষাবাদও চলছে নির্দ্বিধায়। এলাকাবাসীরা বলেন, তাঁরা শুধু শুনেছেন, এই গ্রামের এক কোণে ছিল বিচারপতি পালের বাড়ি—যার আজ সামান্য চিহ্নটুকুও নেই। এত বছরেও সরকারিভাবে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
১৫০ বিঘার এই জমির একটি অংশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বিচারপতি ড. রাধা বিনোদ পাল মডেল স্কুল’, যা ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম। স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও এলাকাবাসীর সহায়তায় গড়ে ওঠা এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়া এই জমিতে স্থাপিত হয়েছে ‘কে এম (কাকিলাদহ-মালিহাদ) মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়’ এবং ‘কে এম (কাকিলাদহ-মালিহাদ) আইডিয়াল কলেজ’। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোথাও জমির মালিক ড. পালের নামকরণ করা হয় নি।
স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, ড. পালের স্মৃতিবহ আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র এখনও ওই অন্চলের বিভিন্ন জনের বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, যদি সরকারিভাবে স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়, তাঁরা এগুলো ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত।
বিচারপতি মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, “সরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ না নেওয়া আমাদের জন্য কষ্টদায়ক এবং একই সঙ্গে লজ্জাজনকও। জাপানিরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে অনেক কিছু করেছে। তাঁরা এখানে ৫০০ শয্যার একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কয়েকবার পরিদর্শনও করেছেন। কিন্তু সরকারি সহযোগিতার অভাবে আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো উনার স্মৃতি স্মরণে প্রায়শই বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এখানে আসেন তবে তাদের একটু বসার মতোও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই আমরা এখানে তাঁর স্মৃতিকে রক্ষায় তার নামে একটি সরকারি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার চাই।”
স্থানীয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল করিম বলেন, “রাধাবিনোদ পাল শুধু বাংলাদেশের গর্ব নন, তিনি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায়। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ এবং গবেষণার সুযোগ থাকা উচিত। তাঁর বেদখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে এবং এই জমিতে স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তন করে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ড. রাধা বিনোদ পালের নামানুসারে নামকরণ করার দাবি জানাচ্ছি। “
গবেষক ড. নুরুল আলম বলেন, “যিনি টোকিও ট্রায়ালে দাঁড়িয়ে ইতিহাস গড়েছেন, তাঁর জন্মভূমিতে একটি স্মৃতি জাদুঘর, গবেষণা কেন্দ্র ও পাঠাগার থাকা উচিত। এটা কেবল একজন মানুষকে সম্মান জানানো নয়, বরং দেশের ইতিহাসকে সম্মান জানানো।”
এ বিষয়ে মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, “আমি বিষয়টি সম্পর্কে আগে অবগত ছিলাম না। আপনাদের মাধ্যমেই জানতে পারলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমি স্থানটি পরিদর্শন করবো এবং ডিসি মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করে উনার স্মৃতিরক্ষা ও জমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।”
সচেতন নাগরিক সমাজ এবং ইতিহাসপ্রেমী মহলের দাবি—কাকিলাদহ গ্রামে ‘রাধাবিনোদ পাল স্মৃতি জাদুঘর’ ও আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হোক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানে, বাংলার এক নিভৃত গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন এমন একজন মহান বিচারক, যাঁর ন্যায়বোধ ও সাহসিকতা আজও বিশ্ব ইতিহাসে চিরজীবিত।
ওপেলিয়া কনি//দৈনিক দেশতথ্য//২৫ জুন ২০২৫