ইরফান উল্লাহ, ইবি :জুলাই আন্দোনকারীদের দুর্বৃত্ত আখ্যা, অবৈধভাবে হলে অবস্থান এবং বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিনিধি ওয়াসিফ আল আবরারকে মারধর করা হয়েছে। এছাড়াও স্বৈরাচারের দোসরদের একটি গ্রুপ তাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন এন্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) রাত ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আজিজুর রহমান হলে এই ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়া হয়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমন্বয়কদের দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হন তারা। এ সময় দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ও প্রক্টরিয়াল বডির সহায়তায় একটি সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে এই ঘটনায় নিষিদ্ধ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান হাফিজ, শাহিন আলম, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন খানসহ বিভিন্ন নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার পক্ষ হয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, আবরার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আজিজুর রহমান হলে অবৈধভাবে দীর্ঘদীন ধরে অবস্থান করছিলেন। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রভোস্টকে দেখিয়ে তাকে নামানোর দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রভোস্ট তাকে হল থেকে নেমে যেতে বললেও তিনি যাননি এবং একটি গ্রুপ তাকে অবৈধভাবে হলে অবস্থান করতে উৎসাহ প্রদান করে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, স্যার নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে হল থেকে নামিয়ে দিয়েছে । সে এলাকায় (পাবনায়) থাকতে ছাত্রলীগের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত ছিল। এখানে আসার পরেও সাংবাদিকতার নামে ছাত্রলীগের বয়ান ছেড়েছে বিভিন্ন ভাবে যেটা সাংবাদিকতার ভিতরে পড়ে না। প্রমাণ পেয়ে স্যার তাকে সিট থেকে নেমে যাওয়ার কথা বলেছেন। সব থেকে বড় বিষয় হলো সে অবৈধভাবে হলে ছিল। তার নিজস্ব সিট ছিল না। অনেকদিন ধরে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ছিল। স্যার নামিয়ে দেওয়ার পরে তাকে কিছু লোক আশ্বাস দেয় যে, স্যার নামিয়ে দিয়েছে তো কি হয়েছে আমরা তোকে দেখবো।
তিনি আরও বলেন, ৫ই আগস্টের পর তাকে শেল্টার দিচ্ছে অন্য একটি পক্ষ। এটা আপনারা সবাই জানেন কোন পক্ষ। নির্দিষ্ট একটা গ্রুপ স্যারের উপর দিয়ে বলেছে, আমরা দেখতেছি তুই হলে থাক। তারা ছাত্রলীগের পুনর্বাসন করতেছে। যেটা ছাত্ররা মেনে নেয়নি এবং তার রুমে গিয়ে তাকে হল থেকে নেমে যেতে বলেছে। হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার পরেও সে আবার উঠেছে। এগুলো সে নিজ থেকে করেনি, নিশ্চয় কারো ইন্ধনে এমন করেছে। তাকে বলার পরে নেমে যাচ্ছিল এমন সময় কিছু লোক উপস্থিত হয়, যাদেরকে হয়তো সে ফোন দিয়েছে তারাই মূলত আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তৈরি করেছে । আর সে নিজেই শুয়ে গিয়েছে, অনেক বেশি আহত হয়েছে এমন না।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ওয়াসিফ আল আবরার কলেজে থাকা অবস্থায় পাবনার বেড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিল। জুলাই আন্দোলনেও তার ভূমিকা বেশ বিতর্কিত। তার প্রোফাইলে জুলাই আন্দোলন কেন্দ্রীক উল্লেখযোগ্য কোনো নিউজও শেয়ার করতে দেখা যায়নি। চারদিকে যখন আন্দোলনকারীরা একে একে শহীদ হচ্ছিল তখন সে হাসিমাখা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে।
তারা আরও বলেন, গত ৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে থাকা শাখা ছাত্রলীগের অফিস ভাংচুর চালায় আন্দোলনকারীরা। এতে একটি সংবাদে আন্দোলনকারীদের দুর্বৃত্ত বলে আখ্যা দেন তিনি।
এদিকে ৫ আগস্টের পরেও বিভিন্ন বিতর্কিত কার্যক্রমে তাকে দেখা যায়। বন্যা কবলিত মানুষের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জমানো জামাকাপড় হরিলুট বলে প্রচার করে বলেও জানা যায়।
এদিকে সহ সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, সাজ্জাতুল্লাহ শেখ, সায়েম আহমেদ ও ইসমাইল রাহাত ঘটনার সময় মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে ওয়াসিফ আল আবরার বলেন,” আমাকে কয়েকজন লোক গিয়ে বলে `তুই ছাত্রলীগ করতি’। আমি অস্বীকৃতি জানাই। তারা বলে এটার প্রমাণ আছে তাদের কাছে। আমি অবৈধভাবে হলে থাকি, আমার বড় ভাইয়ের সাথে থাকি। অনেকেইতো অবৈধভাবে হলে থাকে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী। ঘটনাস্থলে কয়েকজন বলে , ‘২ মিনিটের মধ্যে হল থেকে বের হবি।’ আমি বের হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাকে তারা বলে ‘আপনি হলুদ সাংবাদিক পরে আবার ঝামেলা করবেন’ এসব বলে আমার ফোন নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে তারা রুমের লাইট বন্ধ করে আমাকে মারধর করে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. পারভেজ হাসান বলেন, তার তেমন গুরুতর কিছু হয় নি। আমরা ধারণা করছি তার শ্বাসনালীতে আঘাত লেগেছে। তবে এক্সরে ছাড়া নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়া গিয়ে এক্সরে করানোর পরে ভালোভাবে বুঝা যাবে। আর পায়ে একটু আঘাত লেগেছে তবে সেটা গুরুতর কোনো আঘাত নয়।
হলটির প্রভোস্ট এ.টি.এম মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের হলে ছেলেটার এটাচমেন্ট নেই। জিয়াউর রহমান হলে ওর এটাচমেন্ট। আমরা যেহেতু ঐ রুমে সিট বন্টন করতে চাচ্ছি সেহেতু তাকে বললাম যে তুমি তোমার হলে চলে যাও। সে চলে গিয়েছিল তবে দুই-তিন দিন থেকে ও রুমে আসা-যাওয়া করছে। পরশুদিন আমি ওর রুমমেট ইমনকে বলেছিলাম আবরার যাতে রুমে এসে না থাকে। যেহেতু ওর বিষয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে । এটা জানার পরেও আমার কথা অমান্য করে সে হলে এছে থাকছে। অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকে উসকে দিচ্ছে। এতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া গতরাতে যারা ওকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য গিয়েছিল তারাও আমার সাথে কথা বলে যায়নি। এটা তো হল প্রশাসনের দায়িত্ব। দুই পক্ষকেই আমি মেনে নিতে পারছি না।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহিনুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় আমরা উভয়পক্ষকে নিয়ে বসেছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং হল প্রশাসন মিলে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করবো। কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।