শেখ দীন মাহমুদ,খুলনা প্রতিনিধি: অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, খুুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে মাত্র একজন শিক্ষার্থী দিয়ে। উপজেলার ময়নাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ৩ জন শিক্ষক থাকলেও সেখানকার একমাত্র শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। সঙ্গত কারণে তাই বিদ্যালয়টিতে নেই কচি-কাচার কলকাকলি। ক্লাস শেষে ঘন্টা বাজলেও নেই শ্রেণিকক্ষে বিরাজ করে শুন-শান নিস্তব্দতা। একেবারে নি:সঙ্গ ছাত্রটিকে শিক্ষকরা পাশে বসিয়েই মায়ের আদরে পাঠদান করছেন দাবি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষকের।
ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায় স্কুলটিরও এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। টিনের চালেও ধরেছে
মরিচা। উঁকির মূহুর্ত গুনছে টিনের দৃশ্যমান ছিদ্রগুলো।
আর দশটি স্কুলের ন্যায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক চিত্র হওয়ার কথা ছিল, স্কুল শুরুতে প্রত্যুষে অ্যাসেম্বলিতে বিভিন্ন শ্রেণির ভিন্ন ভিন্ন বয়সীদের সারি সারি দাঁড়ানো। এরপর জাতীয় সঙ্গীত শেষে যার যার শ্রেণিকক্ষের গন্তব্য অনুসরণ। এরপর ক্লাস শুরুতে রোলকল। শুরু হবে পাঠদান,
শিক্ষার্থীদের পড়ার শব্দ, ক্লাশ শেষ ও ছুটির ঘন্টা বাজলেই বাড়ির গন্তব্যে
শ্রেণিকক্ষ ছাড়ার চিরচেনা কলরব। অথচ ময়নাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দৃশ্য সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম।
বিদ্যাপীঠটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানী বলছিলেন, সব আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি সকল সিষ্টেম অনুসরণ করেই চলে তাদের স্কুলটিও তবে ভিন্নতা কেবল একজন মাত্র শিক্ষার্থীকে ঘিরে। তাকে নিয়েই একটি স্কুলের যত আয়োজন। একজন মাত্র শিক্ষার্থী হওয়ায় শ্রেণিকক্ষে ছেড়ে দেননা তারা। পাশে বসিয়ে পরম মাতৃস্নেহে গড়ে তোলা হচ্ছে তাকে।
যদিও একমাত্র শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলটিতে আলাদা একটি কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয়
শ্রেণীর তিনটি বিষয়ের বাংলা, গণিত ও ইংরেজী আলাদা আলাদাভাবে পাঠদান করেন তারা।
স্বপ্না রানী বলেন, একমাত্র শিক্ষার্থী ছাত্র হিসেবে মোটামুটি ভাল হলেও একটি স্কুলের জন্য একজন মাত্র ছাত্র সার্বক্ষণিক নানা শূণ্যতা গিলে খাচ্ছে তাদের। মনের দিক থেকে সবকিছু স্বাভাবিক বলে মানতেও ইচ্ছা করেনা।
তিনি জানান, প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তিযোগ্য আরো চারজন শিশু রয়েছে
তাদের। তবে জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র না থাকায় স্কুলে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি
তাদের। ভর্তি না হলেও নিয়মিত স্কুলে আসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তবে স্কুলটির এমন অবস্থার অন্তরালের রহস্য অনুসন্ধানে ফুটে উঠেছে ভিন্ন
ভিন্ন কারণ। গত কয়েক বছর ধরে গ্রামটিতে শিশু জন্মহার মারাত্নকভাবে হ্রাস পাওয়ায় স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা কম’র জন্য দায়ী।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯১ সালে ময়নাপুর গ্রামের বাসিন্দা তাপস কুমার মলেরদানীয় ৩৭ শতক জমির ওপর স্কুলটি প্রতিষ্ঠা পায় স্কুলটি। তখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনিই দায়িত্বরত ছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে স্কুলটি সরকারিকরণ হয়।
চারিদিকে পানি বেষ্ঠিত হাওড় এলাকায় খানিকটা দ্বিপাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত
ময়নাপুর গ্রাম। সনাতন ধর্মালম্বীদের মাত্র ৪৬টি পরিবারের বসতি নিয়ে গড়ে
ওঠা গ্রাম ময়নাপুর। এক সময় ৬০ জনের মত শিক্ষার্থী ছিল স্কুলটিতে, যাদের সবাই ক্রমশ চলে গেছে মাধ্যমিকে। এরপর গত ৪ বছরে গ্রামটিতে মাত্র পাঁচটি নতুন শিশুর জন্ম হয়েছে। যাদের কেউই এখনো স্কুলে ভর্তিযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এছাড়া গত কয়েক বছরে সেখানকার অন্তত ১৮ টি পরিবার নানা কারণে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। অবশিষ্ঠ পরিবারগুলোতে জন্মহারও কম।
প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের দিকে “ক্যাচমেন্ট এলাকা” ব্যবস্থা চালু হয়। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের কোন অবস্থাতেই ভর্তির সুযোগ নেই।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিকদার আতিকুর রহমান বলেন, তার কর্মজীবনে এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনি দ্বিতীয়টা দেখেননি। একজন শিক্ষার্থী বিশিষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরল।
স্কুলের জমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীণ প্রধান শিক্ষক তাপস কুমার বলেন, স্কুলটি বন্ধ করে অন্যত্র সমন্বয় হলে পার্শ্ববর্তী কেশবপুরের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্কুলটিরও ন্যুনতম দুরত্ব হবে ২ কিলোমিটার। যা ভবিষ্যতে স্থানীয়দের পড়ালেখায় অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে।
দৈনিক দেশতথ্য//এল//