Print Date & Time : 9 May 2025 Friday 7:03 pm

এক নগরবধূর কাহিনী ও আম্রপালী আমের নামকরণ

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। বৈশালী শহরের অনিন্দ্য সুন্দরী এক নগর বধূর (পতিতা) নাম ছিলো আম্রপালী। অতি সুন্দরী হওয়ায় সামাজিক সিদ্ধান্তে তাকে নগর বধূ বা পতিতা বানানো হয়েছিল!

বৈশালী শহরটি এখন ভারতের বিহার রাজ্যের মধ্যে পড়ে। ওই শহরে মাহানামন নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। তার অনেক আম গাছ ছিল। আম্রপালী নামের একটি আম গাছের নীচে তিনি পরিচয়হীন এক শিশু কণ্যাকে একদিন কুড়িয়ে পান। আম্রপালী আম গাছের নিচে পাওয়ায় তার নাম রাখা হয় আম্রপালী।

পালিত পিতার ঘরে শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পা রাখে। এরই মধ্যে ফুটে উঠে তার রূপ। ওই রূপের ঝলকে পাগল হয়ে যায় আশেপাশের লোকজন। কালক্রমে এই খবর পৌঁছে যায় রাজা-বাদশাদের কানে। দিকে দিকে চলতে থাকে আম্রপালীর রূপের আলোচনা সমালোচনা। যারা তার নাম শুনে তরাই তাকে এক নজর দেখতে চায়। যারা দেখে তারা তাকে বিয়ে করতে চায়। এত লোক তাকে বিয়ে করতে চাওয়ায় দিকে দিকে শুরু হয়ে গেল গোলমাল ও মারামারি। তার পানি প্রার্থথী হতে গিয়ে বহু লোক হতাহত হলো।

আম্রপালীর নিরাপত্তা নিয়ে তার বাবা মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরিশেষে তারা বৈশালীর সকল গণ্যমান্য ও ক্ষমতাবান লোকদের কাছে নিরাপত্তা চাইলেন। এ নিয়ে বসলো বৈঠক। সিদ্ধান্ত হলো আম্রপালীকে কোন একক ব্যাক্তির সাথে বিয়ে দেওয়া যাবেনা্। আম্রপালী হবে নগর বধূ। ওই সভার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আম্রপালী পাঁচটি শর্ত দিলেন। সেই শর্তে বলা হলো-

(১) নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় তাকে একটি ঘর দিতে হবে। (২) তার মুল্য হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা। (৩) একবারে মাত্র একজন তার গৃহে প্রবেশ করতে পারবেন। (৪ ) শক্র বা কোন অপরাধীর সন্ধানের জন্য সপ্তাহে একবার তার গৃহ তল্লাসী করা যাবে । (৫) তার গৃহে কে এলেন আর কে গেলেন- এ নিয়ে কোন অনুসন্ধান করা যাবে না। সবাই তার এসব শর্ত মেনে নিলেন। এরপর আম্রপালী দিনেদিনে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়ে উঠলেন। তার রূপের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।  

প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৫০০ শতাধিক। তিনি এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা। এসময় তার একজন সভাসদ বলেন- মহারাজ, এই নর্তকী আম্রপালীর নখের যোগ্য নয়। এরপর তিনি আম্রপালীকে দেখার জন্য উতালা হয়ে উঠলেন।  সভাসদ বললেন, আম্রপালী থাকে বৈশালী রাজ্যে। ওই রাজ্য জয় করা ব্যাতিত আম্রপালীর দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। রাজা ছদ্মবেশ নিয়ে আম্রপালীর ঘরে গিয়ে মুগ্ধ হলেন। আম্রপালী প্রথম দেখাতেই রাজাকে চিনে ফেলে বলেন, আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই কথা শুনে রাজা তাকে রাণী বানানোর প্রস্তাব দেন। আম্রপালী জানান, তার রাজ্যের মানুষ এটা কখনোই মেনে নেবে না। জোর করলে বহু মানুষের জীবন যাবে। তাই রাজাকে দ্রুত চলে যাওয়ার পরামর্শশ দিলেন।

বিম্বিসার সেই পরামর্শশ উপেক্ষা করে বৈশালী আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিলেন। আম্রপালী সাফ জানিয়ে দিলেন। বৈশালী আক্রমণ করলে তিনি তা মেনে নেবেন না। বিফল হয়ে না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে ফিরে গেলেন বিম্বিসার।

খবর পেয়ে আম্রপালীর প্রেমে মশগুল হয়ে উঠলেন বিম্বিসারের সন্তান অজাতশত্রু। তিনি পিতাকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করে নিলেন। এরপর আম্রপালীকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে হেরে গেলেন। এতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে আম্রপালীর সেবায় সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনিও পিতার মতো না পাওয়ার ব্যাথা নিয়ে ফিরে গেলেন।

এরপর একদিন সঙ্গিসাথী নিয়ে চার মাস বৈশালীতে থাকার জন্য এলেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তার দলের শ্রমণ নামের এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে পাগল হয়ে গেলেন আম্রপালী। সে ওই সন্ন্যাসীকে তার ঘরে চার মাস থাকার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন। গৌতম বুদ্ধ তাকে বললেন চার মাস থাকলেও সে নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত।

আম্রপালীর সাথে চার মাস কাটিয়ে ফিরে এলো ওই সন্নাসী। তার সাথে এলো আম্রপালী। তিনি গৌতম বুদ্ধকে বললেন, আপনার কথাই ঠিক। আমি ওই সন্নাসীকে মৌহীনি শক্তি দিয়ে আশক্ত করতে পারিনি। এই সন্নাসীর ত্যাগে আমি মুগ্ধ। সর্বস্ব ত্যাগ করে আমি বুদ্ধের চরণে আশ্রয় নিতে চায়।

এরপর তার সব সম্পদ গরীব দু:খীদের মাঝে বিরিয়ে দিয়ে গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন ইতিহাস বিখ্যাত আম্রপালি।

আর এই আম্রপালী নামেই ১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা ‘দশোহরি’ ও ‘নিলাম’- এই দু’টি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন ‘আম্রপালী’ ।

–ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ব্যাংকার অরিন্দম রায় চৌধুরী দৈনিক দেশতথ্যের জন্য লেখাটি পাঠিয়েছেন। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা অফিস।

এবি/দৈনিক দেশতথ্য/০২ আগস্ট/২০২১