
কুষ্টিয়া মিরপুর ৪৭ বিজিবি বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ৮ম শ্রেনীর ছাত্রী উম্মে ফাতেমা(১৪)কে অপহরণ দলবদ্ধ ধর্ষন ও হত্যার বিচার চেয়ে মামলার বাদি প্রান ভয়ে ঘর ছেড়ে রাত কাটান অন্যত্র। অভিযোগ আছে সহিংস এই ঘটনার শুরু থেকেই কেবলমাত্র একজনকে জড়িত দাবি করে মামলাটিকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয় মিরপুর থানা পুলিশ। অবশেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা লোমহর্ষক দলবদ্ধ ধর্ষন ও হত্যায় জড়িত ৬জনকে সনাক্তসহ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেন। জড়িত এসব অপরাধীদের প্রান নাশের হুমকির কথা জানিয়ে জিডি করেও কোন ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ বিষয়ে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি মিরপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা।
সরেজমিন স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত সহিংস ঘটনা পরবর্তী পুলিশের কর্মকান্ড নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন ও অসন্তোষের অভিযোগ স্থানীয়দের। সহিংস ঘটনার পর স্বাভাবিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে যা করার কথা সেগুলি না করায় পুলিশী সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ মিরপুর থানা পুলিশের বিরুদ্ধে। যদিও স্থানীয়দের এমন অভিযোগ নাকচ করেন সংশ্লিষ্ট পুুলিশ কর্মকর্তা।
স্কুলছাত্রী উম্মে ফাতেমা হত্যা মামলার বাদি পিতা খন্দকার সাইফুল ইসলাম একমাত্র কণ্যাকে হারিয়ে বিচার প্রার্থনা করে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। অবশেষে পুলিশ সদর দপ্তরের হস্তক্ষেপে মামলার তদন্তভার সিআইডিতে দেয়ার পর তদন্তের শুরুতেই অভিযোগের সত্যতা বেড়িয়ে এসেছে বলে দাবি করেন মামলার বাদি। তিনি বলেন, ‘অপরাধীরা আমার কন্যা ফাতেমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষন ও হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া, সেই লাশ উদ্ধারসহ মামলা দায়েরের আগে ও পরে প্রতিটা ক্ষেত্রে মিরপুর থানা পুলিশ আমার কোন কথাই গ্রহন করেননি। আমি মামলার এজাহারে জড়িত সন্দেহে আসামীদের নাম দিতে চাইলেও তা আমলে না নিয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে এজাহার লিখে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পুলিশ স্বাক্ষর করিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে’।
ওই ছাত্রীর মা কুমকুম বেগমের আক্ষেপ,‘আমার একমাত্র কণ্যা ফাতেমা, ওর দুধ খাওয়ার বয়সও পার হয়নি, মাত্র এইটে উঠেছে, ওর সবকিছুর বুঝে উঠার বয়সই হয়নি, অথচ পাষন্ডরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে খুবলে খেয়ে মেরে ফেলেছে। মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে এখন নতুন করে আমাদের জীবনও চরম ভয়ের মধ্যে পড়ে গেছে।’ ওরা এখন আমার বাড়ির আশপাশে এক চরম আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।’ ‘আমরা এখন প্রানভয়ে নিজের ঘরে ঘুমাতেও পারছি না।’
ফাতেমার প্রতিবেশী ফুফু মিলি খাতুনের অভিযোগ, ‘কি আর কবো, রাইত আসলেই আমাদের আতঙ্ক বেড়ে যায়, প্রতিদিন পালা করে পাহাড়া দিয়ে কেউ ঘুমায় কেউ জেগে থাকি, থানায় জিডি করেও পুলিশ একদিনও এসে খোঁজ নেয়নি যে আমরা কিভাবে বেঁচে আছি।’
স্থানীয় মিরপুর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আপান মোল্লা বলেন, ‘আসলে ফাতেমা মার্ডারের ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশ বিতর্কিত ভুমিকা নেয়ায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এখন মামলাটা সিআইডি তদন্ত করায় সবকিছু ঠিক ঠাক বেড়িয়ে আসছে, আমরাও চাই ফাতেমা হত্যার সঠিক বিচার হোক। একদিকে প্রকৃত দোষীকে ধরা হোক আবার নির্দোষ কেউ যেনো হয়রানি না হয় সেটাও বিবেচনা করতে হবে।’ ‘সে কারণে ভুক্তভোগী বিচার প্রার্থী পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি অবিলম্বে বিশেষ কোন মহলের মদদপুষ্ট না হয়ে নিরপেক্ষ ভাবে জনগনের পুলিশিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে।’
স্কুলছাত্রী ফাতেমা হত্যায় জড়িত দেখিয়ে একমাত্র আসামী হিসেবে আপন(১৯)কে দিয়ে আদালতে ১৬৪ধারায় স্বিকারোক্তি জবানবন্দী রেকর্ড করিয়ে শুরু থেকেই মামলাটি নষ্ট করেছে এই অভিযোগ তুলে আপনের দাদা উপজেলার কুরিপোল গ্রামের বাসিন্দা আলি আজগর বলেন,‘পুলিশ বিদ্যুৎ শকসহ নির্মম নির্যাতন করে আপন’কে দিয়ে আদালতে শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য দিতে বাধ্য করে। সেখানে বলানো হয়েছে, আপন একাই নাকি এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। অথচ ময়না তদন্ত রিপোর্টে ডাক্তার নাকি লিখেছে ফাতেমাকে গ্যাং রেফ করে মারা হয়েছে। সিআইডিও এখন সেসব আসামীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে ফাতেমা হত্যায় জড়িত অভিযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের মদদপুষ্ট পৌর আওয়ামীলীগ নেতা কুড়িপোল গ্রামের বাসিন্দা রেকন ঠাকুরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এর পর থেকেই মামলার বাদি পরিবারের উপর চরম হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো শুরু হয়েছে। তবে গ্রেফতার রেকন ঠাকুরের দুই স্ত্রী রেখা খাতুন ও মিনারা খাতুন অভিযোগ অস্বিকার করে বলেন, ‘মামলার বাদি সাইফুল ইসলামের পাওনা টাকা নিয়ে রেকনের সাথে দ্বন্দ ছিলো ঠিকই, তবে ফাতেমাকে ধর্ষন ও হত্যার সাথে কোনভাবেই রেকন জড়িত নয় এবং আমরা কাউকে ভয় দেখাচ্ছিনা’।
স্কুলছাত্রী ফাতেমাকে অপহরণ, দলবদ্ধ ধর্ষন ও হত্যা মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)র পুলিশ পরিদর্শক গৌতম চন্দ্র মালি বলেন, ‘মামলাটির শুরুতেই একমাত্র আসামীকে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বিকারোক্তিমূলক জবানবন্দি করানোর মধ্যদিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিলো। ঘটনার পারিপাশির্^কতা, ঘটনাস্থলের বাস্তবতায় কখনই এই হত্যাকান্ড ও দলবদ্ধ ধর্ষনের ঘটনা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া নিহতের ময়না তদন্ত রিপোর্টেও গ্যাং রেপের কথা বলা হয়েছে; তদন্তের সর্বশেষ অবস্থায় ধারণা করা হচ্ছে ফাতেমাকে অপহরণ ধর্ষন ও হত্যাকান্ডে ৫/৬ জনের সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র জড়িত ছিলো। ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করে আদালতে সৌপর্দ করা হয়েছে, তাদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রেরন করা হয়েছে, বাকীদেরও গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’ রেকন ঠাকুর নামের আসামী যে এই ঘটনায় জড়িত তা আমরা নিশ্চিত হয়েছি- নিহতের মাথার চুলে ও পায়ের আঙ্গুলের ফাকে যে ফুল আটকে ছিলো ওই ফুলের গাছ রেকন ঠাকুরের বাড়িতেই পাওয়া গেছে বলে জানালেন এই তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা দৈনিক দেশতথ্য বাংলাকে জানান, ‘ফাতেমা হত্যা মামলার বাদি সাইফুল ইসলাম হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানে হচ্ছে জানিয়ে যে জিডি করেছে সেটি আমরা আদালতে পাঠিয়ে দিয়েছি, আদালতের আদেশ পেলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে পুলিশ।’
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//আগস্ট ২৪,২০২২//

Discussion about this post