পাইকগাছায় ভূয়া তথ্য দিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে ভূল বুঝিয়ে মুজিব শত বর্ষের ঘর
বরাদ্দ নিয়েছেন একাধিক স্বচ্ছল পরিবার। এসব বরাদ্দপ্রাপ্তদের অনেকেই এখনো ঘরে
ওঠেননি। অনেকে বরাদ্দের ঘরে লিপ্ত রয়েছেন নানা অসামাজিক কার্যকলাপে। আবার
কেউবা নিজের নামে বরাদ্দ নিয়ে অন্যকে ঘরে উঠিয়ে দখল বজায় রেখেছেন। এমন নানা
অভিযোগের পাল্লা প্রতিনিয়ত ভারি হলেও খবর রাখেননা কর্তৃপক্ষের অনেকে।
তবে মুজিব শতবর্ষের ঘর প্রদানে তালিকা প্রস্তুত করতে যাচাই-বাছাই কমিটির কঠোরতা
স্বত্ত্বেও তারা কিভাবে তালিকাভূক্ত হয়েছেন তা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।
সূত্র দাবি করছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভূল বুঝিয়ে নিজেদের ভূমিহীন পরিচয়ে এসব ঘর বরাদ্দ
নিয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে এলাকাবাসী জানায়, এসব স্বচ্ছল পরিবারের একজন কপিলমুনি সদরের
শরিফা বেগম। তিনি নিজে নাছিরপর মৌজাস্থ কপিলমুনি সদরের এসএ ১৯৮ খতিয়ানের প্রায়
অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি হোটেলের স্বত্ত্বাধিকারী।
তালিকা প্রনয়নের সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তথ্য গোপন রেখে কর্তৃপক্ষকে ভূল
বুঝিয়ে ভূমিহীন পরিচয়ে সদরের প্রাণকেন্দ্রে সরকারের কোটি টাকা মূল্যের
সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা মুজিব শতবর্ষের আশ্রয়নের একটি ঘর বরাদ্দ
পান। এরপর নিজ স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েসহ তার সন্তানদের নিয়ে ওঠেন সেই ঘরে।
স্থানীয়রা জানান, তার মেয়ে একজন বিউটিশিয়ান। এর আগে ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে শুরু
করেন, পার্লারের ব্যাবসা। সর্বশেষ মায়ের নামে মুজিব শত বর্ষের বরাদ্দকৃত ঘরে
উঠেই শুরু করেন নামসর্বস্ব পার্লারের ব্যাবসা।
সম্প্রতি বরাদ্দের ঘরের সামনে বধূয়া পার্লারের নামে একটি সাইনবোর্ডও সেটে দেওয়া
হয়। তবে সুষ্ঠু সামাজিকতার স্বার্থে স্থানীয়দের তোপের মুখে সেখান থেকে বোর্ডটি
অল্প দিনেই সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হলেও বন্ধ হয়নি তার ব্যাবসা। এছাড়া সদরের
মুল্যবান সরকারি জমিতে ঘরস্থাপন করায় বরাদ্দপ্রাপ্তরা প্রধানমন্ত্রীর রঙিন
ঘরের সামনে নিজেরা বিভিন্ন সাইজের ছোট-বড় ঘর তৈরি, বেড়া দিয়ে কিংবা পর্দা
টানিয়ে মূল নক্সা ঢেকে রাখছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, তার ঘর বরাদ্দের পেছনে স্থানীয় সলুয়া এলাকার জনৈক হাবিবের হাত
ছিল বেশি। হাবিব স্থানীয় কপিলমুনি ইউএলও অফিসের চুক্তিভিত্তিক দারোয়ান। হাবিব
নিজেও তথ্য গোপন করে কাশিমনগর আশ্রয়নে মুজিব বর্ষের একটি
ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হলে বরাদ্দের ঘরটি টিকিয়ে রাখতে হাবিব
তার নিজ বাড়িটি স্থানীয় জনৈক আসলাম হোসেন নামে এক প্লট ব্যাবসায়ীর কাছে বিক্রি
করে দিয়েছেন বলেও প্রচার পাচ্ছে। যদি বিষয়টি সত্য হয় তাহলে ৬
লক্ষ টাকার বাড়ি থাকতে তিনি ঘর বরাদ্দ পেয়েছিলেন কি করে? এমন প্রশ্ন নানা জনের
মনে বারবার ঘুর পাক খাচ্ছে। এছাড়া হাবিব বাড়ি বিক্রি করে বরাদ্দের ঘরে উঠবেন,
পাশাপাশি শরিফাকেও সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে অভয় দিচ্ছেন। যা
সুষ্ঠু তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
অন্যদিকে কাশিমনগর এলাকার জনৈক আব্দুল ওয়াজেদ, মনোয়ারা বেগমসহ কয়েকজন অনুরুপ
তথ্য গোপন করে মুজিব শতবর্ষের ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। যাদের মধ্যে
ওয়াজেদ তার মেয়েকে এবং মনোয়ারা তার ভাইয়ের মেয়েকে বরাদ্দকৃত ঘরে উঠিয়ে দখল
বজায় রেখেছেন। ইতোমধ্যে কাশিমনগর প্রকল্পে বরাদ্দপ্রাপ্ত স্বচ্ছল আব্দুল
কুদ্দুস মোড়লকে নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সে স্ব-ইচ্ছায় তার ঘরটি ছেড়ে
দিলে সেখানে আরেক ভূমিহীন পরিবারকে স্থলাভিশিক্ত করা হয়েছে।
এরমধ্যে মনোয়ারা বেগমের (মনো) তার এক ভাইয়ের মেয়েকে সম্প্রতি ঐঘরে স্বামীর
অনুপস্থিতে পরপুরুষ নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হলে প্রতিবেশীরা তাদের
আপত্তিকর অবস্থায় আটক করে। অন্যদিকে মাজেদের মেয়েও স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ওই
ঘরে উঠে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। মাজেদও কাশিমনগর এলাকায় আগেই
জমি কিনে সেখানে বসবাসের কয়েক বছর পর তার
নামে মুজিববর্ষের রঙিন ঘর বরাদ্দ হয়। অভিযোগ রয়েছে, কপিলমুনির ইউপির রেজাকপুর
ওয়ার্ড সদস্য রফিকুল ইসলামের এক ভাগ্নে তথ্য গোপন করে ঘর বরাদ্দ
নিয়ে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
অন্যদিকে একাধিক বার আবেদন করেও ঘর পায়নি কাশিমনগর বাজারে ফুটপাথে বসবাসকারী
ছিন্নমুল সুইপার পরিবার। কয়েক বছর আগে তার স্বামী আগুনে পুড়ে
মৃত্যুর পর ৪/৫ জন অসহায় সন্তানসহ তিনি অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বসাবস করছেন
বাজারের খোলা খুপড়িতে। এমনভাবে মানবেতর বসবাস করছেন, কপিলমুনির
সুইপার বাবুইল্লা গাজী। নিজ প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে খোলা আকাশের নীচে বসবাস
তার। অনুরুপ আবেদন করেও ঘর পায়নি রেবেকা বেগম, প্রতিবন্ধী পেয়ারা বেগমের
স্বামী আছাদুল, মনোয়ারাসহ বহু ছিন্নমূল বহু পরিবার।
এব্যাপারে কাশিমনগর ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, আম্ফান পরবর্তী সরকারিভাবে
তাদের কাছে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা চাওয়া হয়। ঐ সময় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্তদের
তালিকা জমা দিলে কর্তৃপক্ষ তাদের ঘর সংষ্কারের পরিবর্তে তাদের অধিকাংশদের
মুজিব শতবর্ষের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে তাদের কোন হাত নেই।
অন্যদিকে শরিফারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন তাই, তাদের বিরুদ্ধে
লিখেও কোন কাজ হবেনা বলে বিভিন্ন স্থানে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছেন। এমনকি তাদের
বিরুদ্ধে কেউ লিখলে তাকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে বলেও প্রকাশ্যে
হুমকি প্রদর্শন করছেন।
এব্যাপারে কপিলমুনি হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক মোসলেম উদ্দীন
দয়াল বলেন, কারা কিভাবে মুজিব শত বর্ষের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দ
নিয়েছেন সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি তদন্তপূর্বক স্বচ্ছলদের বরাদ্দ
বাতিলেরও দাবি জানান তিনি।
কপিলমুনি ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রথম
দিকে তালিকার ব্যাপারে তাদের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। তাই কাউকে ঘর বরাদ্দের
ব্যাপারে সুপারিশ করার প্রশ্নই আসেনা।
কপিলমুনি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ইউএলএও আব্দুস সবুর জানান, তিনি কপিলমুনিতে যোগদানের
আগে যাদের বিরুদ্ধে এমনতর অভিযোগ ছিল তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া
শরিফার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। তবে তার সম্পদের
বিষয়টি তথ্য গোপন করে বরাদ্দ নিয়েছিলেন। বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান তিনি।
পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগমের কাছে জানতে চাইলে বলেন, কারোর
বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমানিত হলে যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।
সর্বশেষ সচেতন এলাকাবাসী তালিকাভূক্ত স্বচ্ছল বরাদ্দপ্রাপ্তদের
পুণ:যাচাই-বাছাইপূর্বক
বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত অসহায় ভূমিহীনদের মধ্যে এসব ঘর বরাদ্দের জন্য যথাযথ
কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//আগস্ট ৩১,২০২২//

Discussion about this post