চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখ সিএমপি’র কর্ণফুলী থানায় গত তিন মাসে মামলা হয়েছে ১৯৫ টি। এরমধ্যে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা রয়েছে ১৩৯টি।
মোট মামলায় আসামি রয়েছে ২৩০ জন। সরকারের জিরো টলারেন্স এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার।
কর্ণফুলী থানাটি শহরের বাহিরে হলেও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন। থানাটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান মহাসড়কে হওয়ায় সিএমপি’র অন্যান্য থানার তুলনায় এখানে মামলা ও জিডির সংখ্যা বেশি। মাদক কারবার, সড়ক দূর্ঘটনা, ছিনতাই, অপহরণ, মলমপার্টি, মারামারি, বিশেষ ক্ষমতা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হচ্ছে বেশি।
গত তিন মাস তথা জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে কর্ণফুলী থানায় মোট মামলা হয়েছে ৬৩ টি। এর মধ্যে শুধু মাদক সংশ্লিষ্টতায় মামলা হয়েছে ৪১ টি। দূর্ঘটনায় ২টি, মারামারি ৯টি, ছিনতাই ২টি, চুরি ৪টি, অজ্ঞান পার্টি ১টি, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ১টি, নারী শিশু ৩টি এতে মোট আসামি ৬৯ জন।
আগষ্ট মাসে মামলা হয়েছে-৬৫টি। এর মধ্যে মাদক সংশ্লিষ্টতায় মামলা রয়েছে ৫৪ টি, মারামারি মামলা ১টি, চুরি ৫টি, অস্ত্র আইনে ২টি, নারী শিশু মামলা ৩টি। এসব মামলায় মোট আসামি ৯৪ জন। সেপ্টেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ৬৭ টি। এরমধ্যে নারী শিশু আইনে ৩টি, চুরি ৯টি, মারামারি মামলা ৯টি, মাদক সংশ্লিষ্টতায় মামলা ৪৪ টি, ডিজিটাল আইনে ১টি, এ ছাড়াও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১টি মামলা হয়েছে। মোট আসামি ৭৩ জন।
মামলার পরিসংখ্যান ও প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বলছে, কর্ণফুলী থানায় বেশির ভাগ মামলা মাদকের। ৮০ ভাগ মামলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে হচ্ছে। ছোট্ট উপজেলা মাদকের তেমন খবরাখবর পাওয়া না গেলেও স্থানীয়রা বলছেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, ও কোস্টগার্ড যে সব অপরাধীরে মাদকসহ মহাসড়কে (কক্সবাজার-চট্টগ্রাম) অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেন। তাদেরকে কর্ণফুলী থানায় প্রেরণ করা হয়।’
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন বাহিনীর আইনশৃঙ্খলার সদসরা শহরের প্রবেশপথ কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেকে অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। ফলে, মামলার জুরিডেকশন (jurisdiction) হিসেবে বিচারব্যবস্থা; আইনগত অধিকারের ব্যাপ্তি বা সীমা; অধিক্ষেত্র এলাকা হিসেবে ওই সব বাহিনীর সদস্যরাও কর্ণফুলী থানায় মামলা করে থাকেন। ফলে, মাদকের তকমা লাগছে কর্ণফুলী উপজেলায়। যদিও মাদক কারবারি যে একদম নেই তা নয়। তবে যতটা মাদক মামলা কর্ণফুলীতে হচ্ছে, ততটা কর্ণফুলীর লোকজন ঘটাচ্ছে না বলে স্থানীয় লোকজন মত প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে, উপযুক্ত স্থান সঙ্কটের কারণে বিগত ২৩ বছর ধরে ভাড়া ভবনেই চলছে কর্ণফুলী থানার কার্যক্রম! ইউনিয়ন পরিষদের ভেতর থানা। আবার থানার উপরেই পরিষদ। এক থানা এলাকার ফাঁড়ি আরেক থানার ভেতর। এসব কিছুর মূলে সিএমপি কর্ণফুলী থানা পুলিশ তাঁদের নিজস্ব আবাসন ও দাপ্তরিক অফিস সঙ্কটে ভুগছেন। কর্ণফুলী থানার পরিধি বেড়েছে। কিন্তু সুযোগ সুবিধা বাড়েনি। সিএমপির অন্য থানা থেকে কর্ণফুলী থানা আবার অপরাধ দমনে পিছিয়েও নেই। যদিও স্বল্প জনবল দ্বারা সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও নেই কোন পুলিশ ব্যারাক ও একত্রীভবন।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে বন্দর, পটিয়া ও আনোয়ারা থানা ভেঙে গঠিত হয় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন হলো কর্ণফুলী থানা। যেটি ২০০০ সালের ২৭ মে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদ এর পুরাতন ভবনে কার্যক্রম শুরু হয়। পরিষদের জরাজীর্ণ-ভবনের কিছু অংশ মাসিক ৩৫ হাজার টাকা ভাড়ায় নেয়। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৩০ হাজারে। এভাবে ২৩ বছর ধরে চলছে। এখনো হয়নি কর্ণফুলী থানার নিজস্ব ভবন। তবে একটি সূত্র বলছে, কর্ণফুলী থানা কাম-ব্যারাক নির্মাণের জন্য জমি কেনা আছে। কিন্তু থানা ভবন নির্মাণের জন্য পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো নকশা জটিলতার কারণে কাজটি থমকে রয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী থানা কাম-ব্যারাক নির্মাণের জন্য সিডিএ কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় ১৫ দশমিক ১১ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের ৩০ জুন জারি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারকমূলে ১৫ কাঠা জমি কিনে নেয় সিএমপি। জমির মালিক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে প্রায় এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। পরবর্তীতে আরো দশমিক ১১ কাঠা জমি সিডিএ থেকে কেনা হয়। কিন্তু পুলিশ সদর দফতর থেকে ৮ তলাবিশিষ্ট থানা ভবন নির্মাণের যে নকশা পাঠানো হয়েছে, সেই নকশায় সিডিএ’র জায়গায় ভবন হবে না। নকশা অনুযায়ী আরো সাড়ে তিন কাঠা জমি প্রয়োজন। এতে থানা ভবন নির্মাণ কাজ থমকে যায়।
আরও জানা যায়, জাতীয় অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্ব বহন করে কর্ণফুলী তীরবর্তী এ থানা অঞ্চল। পাঁচ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত প্রায় তিন লাখ লোক অধ্যুষিত কর্ণফুলী উপজেলার আয়তন প্রতিষ্ঠাকালে আয়তন ১৩৬.৫৯ বর্গ কিলোমিটার হলেও নতুন করে তার পরিধি বেড়েছে। কর্ণফুলী উপজেলাতে পটিয়া থানাধীন যে ১১টি ওয়ার্ড ছিল তা কর্ণফুলী থানাতে প্রবেশ করেছে। শুরুর দিকে এ থানায় লোক সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৪৮ জন। এই কর্ণফুলী উপজেলা ও আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, রায়পুর, বারশত ইউনিয়নের আংশিক এলাকা নিয়ে কর্ণফুলী থানা প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে। এখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কাফকো, সিইউএফএল, বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল-কেপিইজেড ছাড়াও কর্ণফুলী নদীর তীরে শতাধিক বড় মাঝারি শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।
কর্ণফুলী থানার অধীনে তিনটি ফাঁড়ি-শাহমীরপুর, শিকলবাহা ও বন্দর পুলিশ ফাঁড়ি এবং তিনটি ক্যাম্প-কাফকো, কেপিইজেড ও শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুলিশ ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে। এতে রয়েছে একটি পুলিশ বক্সও। থানায় বর্তমানে দু’জন পরিদর্শক, ১৫ জন উপ-পরিদর্শক, ২১ জন সহকারী উপ-পরিদর্শক ও ২২ জন কনস্টেবল কর্মরত আছেন।
থানার পুলিশ সদস্যরা জানান, অস্থায়ী থানা ভবন গ্রামের ভিতরে হওয়ায় ঘটনাস্থলে আসা যাওয়া করতে অসুবিধা হয়। একইভাবে থানায় সেবা নিতে আসা লোকজনকেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতিটি থানায় নারী-পুরুষের জন্য আলাদা হাজতখানা রাখার বিধান থাকলেও কর্ণফুলী থানায় নেই নারী হাজতখানা। তাছাড়া পর্যাপ্ত খালি জায়গা না থাকায় জব্দ করা গাড়ি ও মালামাল রাখতে সমস্যায় পড়তে হয়। অস্থায়ী ব্যারাকে পুলিশ সদস্যদের থাকার জায়গার সংকুলান হয় না। যাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কষ্ট হলেও নিরুপায় হয়ে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে এসব পুলিশ সদস্যরা। রোদ, বৃষ্টি আর শীতে অরক্ষিত ব্যারাকে থাকা মানুষগুলোর কষ্ট যেন নিত্যসাথী।
কর্ণফুলী থানার ওসি মো. দুলাল মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের জনবল সংকট সব জায়গাতেই রয়েছে। আমাদের যে জনবল রয়েছে সেটি কর্ণফুলী থানার জন্য পর্যাপ্ত না। ৯৯৯ সেবা দেওয়ায় জন্যও আলাদা পেট্রোল কার দরকার। অন্যদিকে, পুলিশ সদর দফতরে থানা ভবন নির্মাণের যে নকশা আছে, সেই নকশায় সিডিএ’র জায়গায় ভবন হবে না। সেজন্য নতুন নকশার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে সদর দফতরে। সেটা অনুমোদন হয়ে এলে তারপর থানা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তবুও সিএমপির অন্য থানা থেকে কর্ণফুলী থানা অপরাধ দমনে পিছিয়েও নেই। যদিও স্বল্প জনবল।’
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘বন্দর, পতেঙ্গা ও কর্ণফুলী থানায় জনবল সঙ্কট রয়েছে, সেটা সত্য। তবুও সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। কর্ণফুলীতে ৯৯৯ এ সেবা দেওয়ার জন্য পেট্টোল কার নেই। তবে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখছেন। আর মাদকের বেশির ভাগ মামলা কর্ণফুলীতে হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, কর্ণফুলী শহরের প্রবেশমুখ। বড় চেকপোস্ট কর্ণফুলীতে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালে অবস্থানগত কারণে কর্ণফুলী থানাতেই মামলা রেকর্ড হয়।’
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ/

Discussion about this post