Print Date & Time : 10 May 2025 Saturday 3:49 pm

কর্ণফুলীতে ৫ বছরে ৯ খুন, নেপথ্যে ভয়ঙ্কর ‘কিশোর গ্যাং’

জে. জাহেদ, কর্ণফুলী প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’’। কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না খুন। গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২২) ৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। হামলার ঘটনা ঘটেছে একাধিক। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ১০ জন। নিহতদের অধিকাংশই যুবক।

আহতদের বেশির ভাগ ‍কিশোর। খুনের ঘটনায় আসামিদের ৯০ শতাংশই আবার কিশোর গ্যাং সদস্য। প্রতিবেদকের অনুসন্ধানের এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘যুবকদের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা, কিশোর অপরাধে আধিপত্য বিস্তার ও যুবকরা মাদক সেবনের কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে, কিশোরদের একটা অংশ বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। এখন পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর গ্যাং। এতে উদ্বিগ্ন সাধারণ অভিভাবকরা।

জান যায়, গ্যাং গ্রুপ সদস্যদের অনেকের অভিভাবক প্রভাবশালী ও পরিচিত মুখ নয়তো নেতা। আবার অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে অপরাধ করলেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ আইনের আশ্রয় নিতেও ভয় পান।

এলাকা ভিত্তিক ছোট-বড় গ্যাং তৈরি করে এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে কিশোর সন্ত্রাসীরা। এদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। উঠতি বয়সি ‘বখাটেদের’ দৌরাত্ম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বখাটে সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। রাম দা, ছুরি, চাপাতি, হকস্টিক, ককটেল, সুইচ গিয়ার নাইফ ছুরিসহ অসংখ্য অস্ত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বড়উঠান ইউনিয়নে কিশোর দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি ধারালো অস্ত্রের কোপে ছাত্রলীগ নেতা মামুন আল রশিদ (২৪) খুন হন। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ রাতে উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আজম আলীর পুকুর পাড়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন আজগর আলী (২৫)।

২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি শিকলবাহা এলাকায় দুবাই প্রবাসী রায়হানুল ইসলাম সজিব (২৫) কে গামছা পেঁচিয়ে খুন। একই বছরের ২৫ এপ্রিল সকালে চরলক্ষ্যার খুইদ্দারটেক এলাকায় ছুরিকাঘাতে আরিফ হোসেন দোভাষ (২০) খুন। ১৯ এপ্রিল আবার প্রেমঘটিত কারণে চরলক্ষ্যায় রাত ১০টার দিকে সংঘবদ্ধ কিশোরগ্যাংয়ের হাতে কবিরাজ সায়ের মোহাম্মদ সাগরকে (৩৮) খুন হন। পরে র‌্যাবের হাতের ৬ জন কিশোর গ্রেপ্তার হন।

তাঁর ৫ মাস পর ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় চরলক্ষ্যার মৌলভীবাজারে ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন (২৬) কে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন।
এছাড়াও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের সৈন্যেরটেকে কিশোর গ্যাং কতৃক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডিজে সৈকতের দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট।

২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল ফেসবুক নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে বোরহান উদ্দিন সোহান (১৭) নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করেন কিশোরগ্যাং প্রতিপক্ষরা। রাত ৮টায় উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের খোয়াজনগর গ্রামের মো. ইউসুফ আলী সওদাগরের ছেলে।

একই বছরের ৩০ এপ্রিল কিশোর গ্যাং লিডার সোহেল দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নিজাম উদ্দিন প্রকাশ মধু নামে এক যুবককে কুপিয়ে হাতের কব্জি আলাদা করে ফেলেন। মধুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে পথচারী আবদুস শুক্কুর (৬৮) ও তার স্ত্রী রিজিয়া বেগম (৫৫) গুরুতর জখম করেন সোহেল।

০৩ মে রাতে উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় একই পরিবারের তিন সহোদর আহত হন। মো. ইউসুফ (৩৪), মো. ইসহাক (৩২) ও মো. ইলিয়াছ (৩০) নামে তিন ভাই চমেক মেডিক্যোলের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নেন।

২০২১ সালের ১৯ মে রাত ১০ টায় চরলক্ষ্যা বোর্ড বাজার এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হন মোঃ মুরাদ। তার তলপেটে প্রচুর রক্তকরণ হয়ে চমেক হাসপাতালে মৃত্যু হয়। ২৫ আগষ্ট যানবাহনে ডাকাতি করার অপরাধে র‌্যাবের হাতে আটক হন ৬ কিশোর যুবক। আটকদের শরীর তল্লাশি করে তাদের কাছ থেকে একটি এলজি, দুই রাউন্ড গুলি, তিন রাউন্ড কার্তুজ, চারটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।

একই বছরের ১১ ডিসেম্বর রাত ১১টায় চরপাথরঘাটা এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে কিশোর গ্যাং নেতা রুবেল মোঃ জাহাঙ্গীরের পেটে ছুরিকাঘাত করলে ১৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।

২০২২ সালের ১৬ জুন রাতে কর্ণফুলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপ-পাঠাগার সম্পাদক বিষয়ক রমজান আলী (৩৭) ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন দুর্বৃত্তরা। চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর যুবক কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে। ১০ আগস্ট সন্ধ্যা ৭ টায় ফকিরনীর হাট কাঁচা বাজার এলাকায় পানি চলাচল নিয়ে বিরোধের জের ধরে মো. আনোয়ার (৩১) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে খুন হন।

২০২২ সালের ২ নভেম্বর রাতে খোয়াজনগরে ৪ যুবকের হামলায় রাম দা ও ছুরির কোপে গুরুত্বর আহন কবির মেম্বার বাড়ির নাজমুল হোসেন (২৬)। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। সর্বশেষ, চরপাথরঘাটার খোয়াজনগরে কিশোরগ্যাং সদস্যরা মো. হোসেন নামে এক যুবককে কুপিয়ে হাত বিছিন্ন করেন।

এছাড়াও প্রশাসন আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে থানার স্পর্শকাতর হটস্পট গুলো চিহ্নিত করে রাতে টহল বৃদ্ধি জোরদার করা।

চরপাথরঘাটা কিশোর ও যুব গ্যাং প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার ইসলাম আহমদ বলেন, ‘প্রত্যেকটা পরিবারের নৈতিক দায়িত্ব হবে ছেলে কোথায় যায়, কার সাথে মিশে, কি করে তা দেখা। কেননা, কর্ণফুলীতে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ দুলাল মাহমুদ বলেন, ‘কিশোর সদস্যরা ছোটখাটো অপরাধ করতে করতে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এদেরকে সংশোধন করতে সর্বপ্রথম অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। এরপরেও কেউ অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সিএমপি বন্দর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা জানান, ‘পুলিশ কিশোর অপরাধ দমনে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শুধু আইনের প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা সহজ নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় জড়িত। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিকভাবে এ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।’

দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//