নদীর এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা। গত কয়েক দশকে কর্ণফুলী নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে ছোট হয়ে আসছে কর্ণফুলী তথা চরপাধরঘাটা ইউনিয়ন। নদীর ভাঙ্গনে দক্ষিণ পাড়ের হাজার হাজার মানুষ হুমকির মুখে পড়েছে। বৃটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলে নদীর তীরে বসানো পাথরের ব্লক চরপাথরঘাটাকে সুরক্ষা দিলেও ধীরে ধীরে একাধিক স্থানে তা সরে নদীতে বিলীন হচ্ছে। এলাকাবাসীর মাঝে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অব্যাহত ভাঙ্গনে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা, শিকলবাহা, বড়উঠান ও জুলধা ইউনিয়নের মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। ফলে সীমানা দিক দিয়ে ছোট হচ্ছে কর্ণফুলী। জানা যায়, ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ড (১,২,৩) এবং ইছানগরের তিনটি ওয়ার্ড (৭,৮,৯) এর অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি নদীর গর্ভে চলে গেছে। সেক্ষেত্রে কর্ণফুলী নদীর মালিকও কাগজে কলমে অনেকেই রয়েছেন। এই নাজুক অবস্থানের কারণে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি রক্ষা করতে অতি শিগগরিই সিসি ব্লক বা পাথর ফেলে গ্রাম রক্ষা বাঁধ তৈরি করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চরপাথরঘাটা এলাকার সামাজিক সংগঠক খোরশেদ আলম বিপ্লব বলেন, ভাঙ্গনের করাল গ্রাসে চরপাথরঘাটা অনেকে ছোট হয়ে যাচ্ছে। নদীর মাঝখানে ছিল অনেকের বাড়ি ঘর। ধীরে ধীরে কর্ণফুলীর পেটে ঢুকে যাচ্ছে চরপাথরঘাটাসহ অনেক ইউনিয়নের একাংশ। ফলে, মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে গ্রামবাসী। অতীতে কর্ণফুলীর নদীতে একাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। শতশত পরিবার উদ্বাস্তু বলা যায়।
চরপাথরঘাটার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বিশেষ করে বর্ষার শুরুতেই কর্ণফুলী নদী ভাঙনে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা বাড়ে। এরমেধ্যে কর্ণফুলী নদী গিলে খেয়েছে পুকুর-জলাশয়, হাট-বাজারসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি ও বসতবাড়ী।
কর্ণফুলী শাখার বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম এর দপ্তর সম্পাদক নূর মোহাম্মদ নাঈম বলেন, ‘ অব্যাহত ভাঙ্গনে কর্ণফুলী উপজেলার মানচিত্র ছোট হয়ে আসছে। বদলে যাচ্ছে বহু ইউনিয়নের মানচিত্র। গ্রাম রক্ষা বাদ হিসেবে পাথরের সিসি ব্লক দ্বারা চরপাথরঘাটা তথা কর্ণফুলীর চারপাশ রক্ষা করা জরুরী। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনজর প্রতাশা করছি। কেননা, নদীভাঙ্গনের কোন ব্যবস্থা না করায় প্রতিদিন ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে, নদীর তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ভবন। এদের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীর পানিতে। এই দখল বর্জ্যের কারণে একসময়ের প্রমত্ত কর্ণফুলী ক্রমাগত সংকুচিত হতে হতে আজ প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের ২০২০ সালের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, শাহ আমানত সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় নদীটির প্রস্থ এখন ৫১০ মিটার আর ভাটার সময় ৪১০ মিটার, যা আগে ছিল ৮৮৬ মিটার। রাজাখালী খালের মুখে নদীর প্রশস্ততা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফিরিঙ্গিবাজার পয়েন্টে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার।
তথ্য বলছে, কর্ণফুলী নদী উত্তরে রাউজান উপজেলা ও দক্ষিণে বোয়ালখালী উপজেলাকে রেখে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ভেতর দিয়ে পশ্চিমমুখী প্রবাহিত হয়েছে। কর্ণফুলী নদীতে পূর্ব-পশ্চিমমুখী বাঁধ দেয়ার ফলে কাপ্তাইয়ে নদীর মূল গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও এখনও নদীর সেই অংশের অস্তিত্ব রয়েছে। যেটিকে স্থানীয়রা কাপ্তাই খাল বলে থাকেন। এ খালও নতুন গতিপথের সাথে মিশেছে। বাঁধের উপর পিচঢালা রাস্তা। এর উত্তর পাশে কাপ্তাই লেক আর দক্ষিণ পাশে নদী।
বাঁধের উত্তর পাশের লেকের অংশ থেকে স্পিলওয়ে দিয়ে পানি ছাড়ার কারণে কিছুটা পূর্বদিকে নতুন করে গতিপথ সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে নদীটি কাপ্তাইর ব্রিকফিল্ডের পাশ দিয়ে সেগুন বাগান হয়ে নতুন বাজার, চিৎমরম, শিলছড়ি, রামপাহাড়, সীতারপাহাড়, বড়ইছড়ি, ডলুছড়ি, নারাণগিরি ও চন্দ্রঘোনা কর্ণফুলী পেপার মিল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার গতি পথে ৭ ধাপে আঁকাবাঁকাভাবে নদীর গতি পরিবর্তন হয়েছে।
ডান তীরে চন্দ্রঘোনার মধ্যম কদমতলী ও বাম তীরে কোদালা চা বাগানের মধ্যখানে এসে জেগে ওঠা বিশাল চরে বাধাগ্রস্ত হয়ে কর্ণফুলী গতিপথ হারায়। গোচরা বাজার পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার পশ্চিমাংশে সরাসরি এসে আবার দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার পর আবারও সরফভাটা ইউনিয়নের চিড়িঙ্গা এসে বাঁক নেয় সরাসরি পশ্চিমে। কর্ণফুলী জুট মিল থেকে চিরিঙ্গা পর্যন্ত বাঁক নেয়া কর্ণফুলীর কাউখালী অংশে ছিল এক বিশাল গোল।
কাপ্তাই বাঁধ থেকে ২২ কিলোমিটার নিচে এসে নাজিরার চরে ধাক্কা লাগা কর্ণফুলী আবারো গতিপথ হারায়। বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরা ও রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী হয়ে বাঁক নিয়েছে। কুশাইল্যা মুড়ার পাশ দিয়ে বোয়ালখালী জেলেপাড়া ঘেঁষে বয়ে গেছে ভাণ্ডালজুড়ি খাল। কর্ণফুলীর ঢেউ নাজির চর ফেলের আসার পর থেকে আবার পূর্বের চেহারায় রূপ নেয়। বোয়ালখালীর খুইশ্যাল ক্ষেত, ভারাম্বাঘাট, হরেশ চন্দ্রমুন্সীর ঘাট, কেরানী বাজার, খেলা ঘাট ও ওপারের রাউজানের কোয়েপাড়া, পাঁচখাইন, লাম্বারহাট, বাগোয়ান, চৌধুরী হাট, সূর্যসেন পল্লী, নোয়াপাড়া হয়ে কর্ণফুলী নদী ধনুকের মতো বেঁকে কচুখাইন এলাকায় এসে হালদায় মিশেছে।
আর বোয়ালখালীর খরণদ্বীপ থেকে হেলে-দুলে বয়ে এসেছে চরণদ্বীপে। চরণদ্বীপ মসজিদ ঘাট থেকে ফফিরাখালী বাজার পেরুতেই ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী হাট গিলে খেয়েছে কর্ণফুলী। চৌধুরী হাট থেকে ক্রমশঃ বেঁকে নিয়ে কধুরখীল হয়ে আবার বাঁক নিয়েছে কর্ণফুলী। অপর পাড়ে কর্ণফুলী বুক চিরে বয়ে গেছে হালদা নদী। রাউজানের হালদা মোহনা ও কধুরখীলের অংশ থেকে আড়াআড়িভাবে বয়ে চলেছে কর্ণফুলী। হালদার মোহনার পৌনে এক কিলোমিটার এগোলেই চোখে পড়ে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু। ব্রিটিশ আমলের নির্মিত প্রাচীনতম নিদর্শন এটি। তবে বোয়ালখালী অংশে ভাঙন দেখা দিলেও দখল চলছে অপর অংশে। কালুরঘাট সেতুর পর থেকে আড়াআড়িভাবে চলেছে কর্ণফুলী।
পটিয়ার কোলাগাঁও ও নগরীর বাকলিয়া মাঝামাঝি অংশে কর্ণফুলীর বুক ফুঁসে জেগে উঠেছে বিশাল এক চর। তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু ও শাহ আমানত সেতু এলাকায় এসে কর্ণফুলী বক্রাকার ধারণ করেছে। শাহ আমানত সেতু পার হয়ে দেখা মিলে অন্যরকম কর্ণফুলী। দুই পাড়েই নগরায়নের ছোঁয়া। সেতুর পেরুনোর পর চাক্তাই-রাজাখালী, ফিরিঙ্গীবাজার, সদরঘাট, মাঝির ঘাট এলাকায় শত শত নৌকা, জাহাজ, সাম্পান আর জন কোলাহলে মুখরিত। কর্ণফুলী তীরে গড়ে উঠেছে অন্যরকম রাজ্য।
দক্ষিণে আনোয়ারার ইছানগর ও নগরীর মাঝিরঘাট থেকে কিয়দাংশ বাঁক নিতে শুরু করে কর্ণফুলী। শহরাংশের মাঝিরঘাট থেকে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে নৌবাহিনী ঘাঁটি এলাকায় গিয়ে সোজাভাবে দাঁড়ায় কর্ণফুলী। আনোয়ারার রায়পুর অংশ থেকে ক্রমশ: চাঁদের মতো গতি পরিবর্তন করেছে কর্ণফুলী। ওই বাঁকটি প্রায় ৪০ মিটার পর্যন্ত গিয়ে খাড়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দর-এর প্রত্যন্ত পশ্চিম কোণ থেকে সরাসরি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে নদীটি চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৭ কি.মি. সম্মুখে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত সমুদ্রগামী বড় বড় জাহাজ সারা বছর এ নদীর উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে এবং কাপ্তাই পর্যন্ত বড় নৌকা, ট্রলার এবং সবধরনের ফ্রেইটার ও লঞ্চ আসা-যাওয়া করতে পারে।
কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাট থেকে নিম্নমুখে তার গতিপথের সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করেছে। এ পরিবর্তন এক শতকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। একসময় নদীটির গতিপথ ছিল কালুরঘাট থেকে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী এবং এর দক্ষিণ তীর বরাবর ছিল সাম্পানঘাটা, শুলকবহর, কাপাসগোলা, চকবাজার, রুমঘাটা, ঘাট ফরহাদবেগ, বক্সিরহাট ও পাথরঘাটা প্রভৃতি স্থান।
কিন্তু ধীরে ধীরে এটি বাম দিকে পিছিয়ে আসে এবং ডান তীর বরাবর বিশাল ও বিস্তীর্ণ উর্বরভূমির সৃষ্টি করে যা এখন চর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, চর চাক্তাই ইত্যাদি নামে পরিচিত। আলোচ্য ঘাট ও বাজারসমূহ এক সময় শহরের পূর্ব প্রান্ত বরাবর কর্ণফুলী নদীর ডান তীর জুড়ে অবস্থান করত, কিন্তু বর্তমানে সেগুলি নদীর গতিপথ থেকে অনেক দূরে। এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও গুরুত্ব রয়েছে, কেননা এ নদীর মাধ্যমেই মুগল ও ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব সীমানা চিহ্নিত করা সহজ হয়। পর্বতমালার উচ্চতার সঙ্গে তাল রেখে কর্ণফুলী নদী তার পুরাতন গতিপথ অব্যাহত রেখেছে বলে এটিকে একটি ভূমিজপূর্ব বা প্রাচীন নদী বলা হয়ে থাকে। নদীটি কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা সড়ক বরাবর প্রাংকিয়াং থেকে ওয়াছড়ি পর্যন্ত সংকীর্ণ ও সরল।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর বিভাগ-১) নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, ‘কর্ণফুলীর যে যে ইউনিয়নে নদী ভাঙন রয়েছে। সে সব এলাকা পরিদর্শন করার জন্য শিগগরই অফিসার পাঠানোর ব্যবস্থা করব। আমাদের পর্যাপ্ত বরাদ্দ রয়েছে। যেখানে যেখানে পাথরের সিসি ব্লক বসানো দরকার দিতে পারব। গ্রামবাসীর সহায় সম্পদ রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড অবশ্যই করবেন।’
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ বলেন,‘কর্ণফুলী নদীর বন্দর শাসিত এলাকা হালদা মোহনা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত ১০ মাইল কর্ণফুলী রক্ষায় ২০১৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ ‘স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগাং পোর্ট’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ঠিক রেখেই সেই পরিকল্পনা করা হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নাই।’
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ/

Discussion about this post