রাজনীতি সবার জন্য হলেও ক্ষমতা কিন্তু তা নয়। ক্ষমতায় যেতে হলে লাগে নানা ধরণের হিসাব নিকাশ। এসব হিসাব নিকাশ পেরিয়ে যারা ক্ষমতায় যান এবং টিকে থাকেন তারাই যোগ্য। সেই হিসেবে হিন্দু প্রধান কলকাতার প্রথম বাঙালি এবং মুসলিম মেয়র হয়েছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি ১৯৩৫ থেকে ৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।
ফিরহাদ (ববি) হাকিম ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কলকাতার মেয়র পদে আসীন রয়েছেন। তার ৭১ বছর আগে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতাত্তোর কালে কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র হয়েছেন ফিরহাদ হাকিম।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কোলকাতার সাথে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগ সবচেয়ে বেশী হলেও কোলকাতার রাজনীতি ও ইতিহাস খুব লোকেই জানে। ১৭৭৩ সালে কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এই সময় সেখানে একটি পরিষেবা ও ক্ষুদ্র পুলিশ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৭৯৪ সালে পৌর প্রশাসনের দায়িত্ব কালেক্টরের হাত থেকে ‘জাস্টিস অফ দ্য পিস ফর দ্য টাউন’-এর হাতে অর্পন করা হয়।
উনিশ শতকে বাংলার গভর্নর-জেনারেল কলকাতার পৌর কাঠামোর উন্নতি ঘটান। ১৮৪৭ সালে করদাতারা ৭জন বেতনভুক কর্মচারী নির্বাচিত করে পৌর বোর্ড গঠন করেন। ওই বোর্ড শহর উন্নয়ন, রাস্তা রক্ষনাবেক্ষণ, সম্পত্তি ক্রয় ইত্যাদির দায়িত্ব পায়। ১৮৫২ সালে নতুন বোর্ড দুজন নির্বাচিত ও দুজন সরকার মনোনীত সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এই বোর্ডের কাজের বিস্তৃতি ঘটিয়ে গৃহনির্মাণ, গাড়ি, ঘোড়া, লাইট (আলো) উপর কর ধার্যের দায়িত্ব লাভ করে।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শত বছরের শাসনের অবসানের পর উপ-মহাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা বৃটিশের উপর ন্যাস্ত হয়। এরপর ১৮৬০ থেকে ১৮৬৮ খ্রীঃ পর্যন্ত বাংলায় মিউনিসিপ্যালটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ১৮৬৩ সালে কলকাতার পৌরকাঠামোর নতুন বোর্ড গঠন হয়। সেই বোর্ড নির্বাচিত ভাইস-চেয়ারম্যানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার, সার্ভেয়ার, ট্যাক্স কালেক্টর নিয়োগ করে। এরপর জলাবদ্ধতা ও জল সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। ব্যবসা বানিজ্য ও জনগনের জন্য বাজার ব্যবস্থা ও ফুটপাথসহ রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়।
এই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৪ সালের ১ জানুয়ারি নির্মিত হয় কলকাতার ১ম পৌর বাজার বা হগ নিউ মার্কেট ও পশু জবাই কেন্দ্র। পৌর চ্যেয়ারম্যান স্যার স্টুয়ার্ট হগ এই পৌর বাজার নির্মাণে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন। নির্মাণের ২৮ বছর পর ১৯০৩ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারীভাবে বাজারটির নামকরন করা হয় ‘স্যার স্ট্যুয়ার্ট হগ মার্কেট’ বা হগ মার্কেট। বাঙ্গালিরা এই মার্কেটের নাম দিয়েছিল ‘হগ সাহেবের মার্কেট’। এটা সর্ব সাধারনের কাছে ‘নিউ মার্কেট’ নামে অধিক পরিচিত।
সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রবিবার ছাড়া অন্যান্য দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকে যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় রন্ধন দ্রবাদি মশলা, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফলমূল, ইলকট্রোনিক্স সামগ্রী, বাক্স-ব্যাগ-ছাতা-লাঠি, মিষ্টি, গারমেন্ট পোষাক, শাড়ি-কাপড়, গহনা, ফুল, শিশু খাদ্য সবই এক ছাদের নীচে মেলে। ১৯৮৫, ২০১১ এবং ২০১৫ সালে আগুন লেগে মার্কেটের বিপুল ক্ষতি হয়।
১৯২৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ বাংলা সরকারের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনকে গণতন্ত্রীকরণ করে সরকারের হস্তক্ষেপ খর্ব করেন। মহিলারা ভোটাধিকার অর্জন করেন। কর্পোরেশনের সামনের সড়ুকটির নামকরণ করা হয় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড।
২০০১ সালে ‘ক্যালকাটা’ বাদ দিয়ে ‘কলকাতা’ নাম চালু করা হলে পৌরসংস্থার নাম ‘কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন’ করা হয়।
কলকাতা পৌরসংস্থার ১ম বাঙালী মেয়র ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস (১৯২৪-১৯২৫)। তাঁর সময়ে ভোটে জিতে কাউন্সিলর হওয়ার পর পুরসভার সি ই ও হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। পুরসভার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। এজন্য তিনি পরিষেবা দিতে অর্ধেক বেতন নিতেন।
২য় মেয়র দেশপ্রিয় ব্যারিষ্টার যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (১৯২৫-১৯২৮)। বাড়ী চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানায়। তাঁর স্ত্রী ব্রিটিশ নাগরিক নেলী সেন। নেলী সেন ১৯৩৩ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৫ ম মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু (২২-৮-১৯৩০ থেকে ১৫-৪-১৯৩১) ৭ম এ কে ফজলুল হক (৩০-৪-৩৫ থেকে ২৯-৪-১৯৩৬)। এর পরের ইতিহাস ছিল গতানুগতিক।
দৈনিক দেশতথ্যের পাঠকদের জন্য লেখাটি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মালিক খসরু। লেখাটি সম্পাদনা করেছেন আব্দুল বারী।
![প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন](https://dailydeshtottoh.com/wp-content/plugins/wp-print/images/printer_famfamfam.gif)
Discussion about this post