Print Date & Time : 23 April 2025 Wednesday 9:10 am

কলকাতা মহানগরীর মশা উপাখ্যান ও প্রসঙ্গিক কিছু কথা

অতি ক্ষুদ্র একটি প্রাণীর নাম মশা। এই মশা ক্ষুদ্র হলেও মানবের প্রাণ হরণে এর জুড়ি মেলা ভার। আড়াই শ’ বছর আগে মশা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিল কলকাতার কবি সাহিত্যিকরা। প্রশ্ন হচ্ছে মশার মতো অতি তুচ্ছ একটি ক্ষুদ্র প্রাণী কেন বড়বড় কবি সাহিত্যিকদের লেখার বিষয় হবে? সে সময়ের তথ্য অনুসন্ধান করে জানা গেছে এই প্রশ্নের উত্তর।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজরা মহা আনন্দে ছিলেন। নবাবের বাহিনীর লোকেরা তাদের না মারতে পারলেও বাংলার মশা বাহিনী ইংরেজদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। মশা-মাছির দৌ্রাত্বে তাদের মনে ছিল না শান্তি। ক্যাপ্টেন হ্যামিলটনের বর্নণায় আছে কলকাতায় তখন বাস করতেন ১২০০ ইংরেজ। এ সময়ে কালা জ্বর ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৪৬০ জন। মৃত্যুর এই সংখ্যা তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা এই জ্বরের নাম দেয় ‘ব্লাক ফিভার’।

১৮২২ সালে কলকাতায় বেড়াতে আসেন কবি ফ্যানী পার্কস নামের এক ইংরেজ রমনী। তিনি কলকাতার আমোদ-ফুর্তির কথা লিখেছেন। সাথে জুড়ে দিয়েছেন মশার অত্যাচারের তীব্রতা ও চুলকানির প্রকোপের কথা। এতে ওই ইংরেজ মহিলার ভ্রমণ আনন্দ কিভাবে বিষাদে পরিনত হয়েছিল তা লেখা হয়েছিল। ওই ইংরেজ মহিলা ছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের বোন। তার মূল নাম ছিল এমিলি ইডেন। তার নামে গড়ে উঠেছে ‘ইডেন উদ্যান’। তিনি কলকাতায় অবস্থানকালে কিভাবে মশা-মাছির দাপটে হেনস্থা হয়েছিলেন তা আত্মকথায় তুলে ধরেন।

ইডেন উদ্যানের কথা বলতে গেলে বলতে হয় বর্তমানের ক্রেজ ক্রিকেট নিয়ে কথা। এই মাঠে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের ১ম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৭-১৮ সালে। ১ম টেষ্ট ম্যাচ হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। আর ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফাইনাল। খেলাটি ছিল অষ্ট্রেলিয়া বনাম ইংলন্ডের মাঝে। ইংল্যান্ড হেরেছিল৭ রানে।

১৭৭২ সালে ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এর সদর দপ্তর করা হয়। তখন কলকাতায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য রাস্তা ছিল না। ১৮১৪ সালে ‘লটারী কমিটি’ করে জন সাধারণের জন্য সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৮৩৬ সালের মধ্যে এ অবস্থার সামান্য পরিবর্তন আসে। সে সময়ের এই উন্নতির বর্ণনা রয়েছে কবিগুরুর লেখায়।

কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থে লিখেছিলেন-‘আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকড়া-গাড়ি ছুটছে তখন ছড় ছড় করে ধুলো উড়িয়ে। দড়ির চাবুক পড়ছে হাড় বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটর গাড়ি। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে পান চিবোতে চিবোতে, কেউ বা পালকি চ’ড়ে, কেউবা ভাগের গাড়িতে। …তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলী বাতি। কেরোসিনের আলো যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক। আমাদের পড়ার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ।’

১৮৪১ সালে কলকাতা মিউনিসিপালিটির জন্ম হয়। ১৮৫৪ সালে শুরু হয় রেল লাইন নির্মাণের কাজ। একই সময় চলতে থাকে কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নির্মাণ কাজ। এভাবে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ ঘটে আজকের কলকাতার।  প্রতিষ্ঠার ১৩৯ বছর পর ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়।

এক সময় কলকাতা ছিল ছড়া দিয়ে মোড়ানো। ছড়া ছিল মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। এ সময় সংবাদপত্র ছিলনা। মানুষের সুখ, দুঃখ, আশা-নিরাশা, ভাল-মন্দ, সামাজিক প্রতিবাদ এমন কি শ্রেণী সংগ্রাম, উৎসব, নানা সমালোচনার মাধ্যম ছিল ছড়া।

ছড়া সুর করে এক সময় পথে, গ্রামে, বাজার এলাকায়, বাড়ির আঙ্গিনায় দল বেঁধে পরিবেশিত হতো। ছড়া কি ছিল শুধু মাত্র আমোদ-প্রমোদের মাধ্যম? অগনিত ছড়া এক সময় কলকাতার বাতাসে ভেসে বেড়াত। যার অধিকাংশ গিয়েছে হারিয়ে। লক্ষ লক্ষ ছড়ার মাঝে হাতড়িয়ে খুঁজে নেব দু’চারটি। যার মাঝে প্রাচীন ইতিহাসের বিভিন্ন অনুসংগ, বিশেষ ঘটনার কথা এবং সাধারণ জনগনের মনের চিত্র ফুটে উঠেছে। পুরানো কলকাতায় কবিয়ালদের আধিক্যও কম ছিল না। কোন ঘটনা নিয়ে তারা তাৎক্ষনিকভাবে গান রচনায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ধীরাজ কবিয়াল।

জানা যায়, তিনি রচিত গানে সমাজের অসংগতির বিরূপ এবং জোর সমালোচনা করতেন। অনেকের মতে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ঈশ্বর গুপ্ত যেমন উদ্ভুত পরিস্থিতির সমালোচনা করতেন তেমনি এই কবিয়াল গানের মাধ্যমে আঘাত হানতেন সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। তবে সেকালে সমালোচনা জোর করে, ভয় দেখিয়ে বন্ধের উদ্যোগ নিতে দেখা যেত না।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (৬ মার্চ ১৮১২ – ২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯) ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি কবি ও সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি সংবাদ প্রভাকর এর সম্ছিপাদক ছিলেন। কলকাতায় মশা মাছির উপদ্রব নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতাটি ছিল সে সময়ের সর্বাধিক আলোচিত একটি কবিতা। ওই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-“রেতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে কলকেতায় আছি”। মশা মাছির উপদ্রব নিয়ে যে একটি ছড়া আছে তা নয়। প্রাচীন কলকাতার মশার তীব্র আক্রমনের উপদ্রব নিয়ে প্রায় আড়াই শত বছর আগে রচিত হয়েছিল “মশা-মাছি উপাখ্যান”।

কবি ঈশ্বর গুপ্তের বাড়ি ছিল কাঁচড়াপাড়ায়। কলকাতার জোড়াসাঁকোতে ছিল তাঁর মামার বাড়ি। তিনি একবার সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কলকাতা শহর দেখে তিনি হয়েছিলেন বিমোহিত। লাল-নীল বাতির আলো ঝলকানি, গাড়ি-ঘোড়ার ছুটাছুটি, খোলা-মেলা জায়গা, বাগান ইত্যাদি তাঁর মন ছুয়েছিল। কিন্তু সকল আনন্দে বাধ সেঁধেছিল মশা মাছির উপদ্রব ও আক্রমন। এ নিয়ে তিনি যে কবিতা লিখেছিলেন তা আজও সুন্দরী কলকাতার গায়ে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে।

মশা যে কেবল কলকাতায় ছিল তা নয়। আমাদের দেশেও মশা মাছির উপদ্রব কম ছিল না। বাংলাদেশে মশা নিয়ে তেমন কোন বিখ্যাত সাহিত্য কর্ম না থাকলেও প্রবাদ কিন্তু কম নেই। যেমন কথায় কথায় বলা হয়- ‘মশা মারতে কামান দাগা’। মহানগরী গুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়েছে মশা। মশা নিয়ে মেয়রদের চেয়ার চরে যায়। আবার অতি ক্ষুদ্র প্রাণী মশা নিধন করতে ব্যায় হয় কোটি কোটি টাকা। তারপরও মশাকে নি:বংশ করার লাগসই কোন প্রযুক্তি আজও কোন দেশেই হয়নি।

মশার ভয়ে আগের যুগের রাজা বাদশারাও মশারীর মধ্যে পালিয়ে থাকতেন। কাজেই মশাকে তুচ্ছ প্রাণী কিংবা ফেলনা কিছু বলে মনে করা যাবেনা। মশা থেকে নিরাপদ না থাকতে পারলে আমাদের দেশেও রচিত হতে পারে কলকাতার মতো “মশা উপাখ্যান”।

লেখক: মালিক খসরু, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা অফিস।

এবি/ ১৫ আগস্ট/২০২১।