শাহীন আহমেদ, কুড়িগ্রাম:
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আযহা উপলক্ষে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বরাদ্দ দেওয়া ভিজিএফ কর্মসূচীর তালিকা প্রস্তুত ও চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
তালিকায় দরিদ্রদের নামের পরিবর্তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে সরকারি- বেসরকারি চাকরিজীবী সহ প্রায় এক হাজার ৮ শত স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম।
জনপ্রতিনিধি ও তালিকা অনুমোদন কমিটি যোগসাজসে চাল আত্মসাতের উদ্দেশ্যে প্রকৃত দরিদ্রদের বাদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে স্বচ্ছলদের নাম দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
অভিযোগ উঠেছে, এসব নামের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া স্লিপ চেয়ারম্যান মেম্বাররা ব্যাবসায়ীদের নিকট আগেই বিক্রি করে দেন । তবে এবার ঈদে বিতরণের সময় স্থানীয় সচেতন জনতা বাধা দেওয়ায় এসব স্লিপের চাল উত্তোলন করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। এতে ঈদুল আযহার আগের দিন বিতরণ শেষে গুদামে থেকে যায় প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল। তবে ঈদুর ফিতরে একই তালিকায়ে চাল বিতরণ শেষ করা হয়। সেসময় ওই সাড়ে ১৮ মেট্রিকটন চাল কার হাতে চলে গেছে তা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৮ নং বলদিয়া ইউনিয়নে ঈদুল আযহা উপলক্ষে ৫ হাজার ৭৪৫ জন হতদরিদ্র মানুষের জন্য ১০ কেুজি হারে ৫৭.৪৫ মেট্রিকটন চল বরাদ্দ দেওয়া হয়। তালিকা প্রস্তুত করেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়াম্যান ও মেম্বাররা। পরে উপজেলা কমিটি যাচাই বাছাই করে তালিকা অনুমোদন দেয়। তবে ইউনিয়নের হতদরিদ্র মানুষের নাম বাদ দিয়ে এক হাজার ৮ শ স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।
যেখানে চাকরিজীবীদের নামও রয়েছে। তালিকা যাচাইয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাথে যাচাই বাছাই কমিটির অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজসে এসব অনিয়ম করা হয়।
ভিজিএফের তালিকায় অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন। তালিকা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে পরিবর্তিত এই তালিকা করতেও অনিয়মের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানায়, গত ঈদুল ফিতরে তালিকা নিয়ে অনিয়ম প্রকাশ হলে এবার ঈদুল আযহা উপলক্ষে বরাদ্দকৃত চাল বিতরণে আবারও তালিকার অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ তোলেন স্থানীয় সচেতন মহল। পরে তালিকায় অন্তর্ভূক্ত নামের সাথে স্লিপ প্রাপ্ত মানুষকে মিলিয়ে চাল বিতরণ করে প্রশাসন। এতে বেড়িয়ে আসে তালিকায় প্রায় ১ হাজার ৮ শ স্বাবলম্বি ব্যক্তির নাম। এসব ব্যক্তি চাল গ্রহণ করতে উপস্থিত হননি। পরে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল ইউনিয়ন পরিষদ গুদামে সিলগালা করে রাখা হয়। ধারণা করা হচ্ছে এসব তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের স্লিপের চাল তাদের অগোচরে চেয়ারম্যান মেম্বাররা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে প্রশাসনের নজরদারিতে তা ব্যর্থ হয়।
তালিকা যাচাই করে দেখা যায়, ১১৩৮ নম্বর নামের ঘরে রয়েছেন শ্রী স্বপন কুমার সরকার। তিনি বলদিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ২৯২১ নম্বরে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামের একজন ব্যবসায়ী,২৯৩৯ নম্বরে রয়েছে সেচ্ছাবেক দলের নেতা লুৎফর রহমানের নাম, ২৯৪৯ নম্বর তালিকায় রয়েছে স্বচ্ছল ব্যাক্তি আইনুল হক, ২৫৭ নম্বরে রয়েছে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফুজ্জামানের নাম, ২৫৮ নম্বর তালিকায় রয়েছে আরমান আলী নামের আরেকজন প্রাধমিকের শিক্ষকের নাম। এভাবে প্রায় ২হাজার সচ্ছল মানুষের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
তালিকাভূক্ত স্বচল ও চাকরিজীবী ব্যক্তিদের দাবি, তারা কেউ জানেন না তাদের নাম কীভাবে তালিকাভূক্ত হয়েছে।
শিক্ষক আরমান আলী ও আশরাফুজ্জামান বলেন, আমরা জানিনা কীভাবে আমাদের নাম ভিজিএফের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। নাম তালিকায় রেখে আমাদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে ।
ভিজিএফ তালিকায় নাম থাকা ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক দলের নেতা লুৎফর রহমান জানান, তার নাম ভিজিএফের তালিকায় দেখে তিনি হতভম্ব হয়েছেন। কারা তার নাম তালিকাভূক্ত করেছেন সেটা তার জানা নেই।
তিনি বলেন, ‘এসব নাম দিয়ে চেয়ারম্যান মেম্বাররা চাল বিক্রি করে দেয়। তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ।’
গত ৬ জুন ঈদুল আযহার আগের দিন ইউনিয়ন পরিষদে হাজারো হতদরিদ্র নারী পুরুষ চাল নিতে এসে সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় খালি হাতে ফেরত যান। এদের মাঝে অনেকে ঈদুল ফিতরে চাল পেলেও এবার পাননি।
ইউনিয়ন চেয়াম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এই তালিকা দিয়ে ঈদুল ফিতরে চাল বিতরণ করা হয়েছিল। এবারও একই তালিকা দিয়ে চাল বিতরণ করা হয়েছে। তালিকায় ভূলক্রমে কিছু সচ্ছল ব্যাক্তির নাম অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তবে স্লিপ বিক্রির অভিযোগ সত্য নয়।’
ওই ইউনিয়নে চাল বিতরণের দায়িত্বে থাকা ট্যাগ কর্মকর্তা ও ভূরুঙ্গামারী পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ বিতরণের শেষ দিনে ১৮৪০ জন তালিকাভূক্ত ব্যাক্তি চাল নিতে আসেন নাই। এসব ব্যাক্তির বিপরীতে প্রায় সাড়ে ১৮ মেট্রিক টন চাল গুদামে রেখে সিলগালা করে রাখা হয়েছে।’
ভিজিএফ কর্মসূচীতে হতদরিদ্রদের তালিকা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম ফেরদৌস। ইউএনও বলেন, ‘তালিকা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় চাল বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে, পরবর্তিতে তালিকা সংশোধন করে অবশিষ্ট চাল বিতরণ করা হবে।’

Discussion about this post