শাহীন আহমেদ, কুড়িগ্রাম:
কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতির ভাতিজা পরিশামছুল আলম জেলা শিক্ষা অফিসে বহাল তবিয়তে আছেন দীর্ঘ ১০ বছর। নিজ জেলার অধিবাসী হওয়ায় ঘুষ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষ অতিষ্ট হলেও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা কেউ। চতুর শামছুল আলম দুর্নীতির সাম্রাজ্য চালাতে গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মুল হোতা শহরের তিন শিক্ষক নেতা । তাদের মাধ্যমে চলে লেনদেন এবং সকল অপকর্ম। একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা সুফল পায়নি ।
অনুসন্ধান ও অভিযোগে জানাযায়, জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যে করে গত ১০ বছরে কম পক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া ও বিভিন্ন অজুহাতে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের নিকট নানা অযুহাতে উৎকোচ ও উপহার গ্রহণ করেন। এছাড়া স্বজনপ্রীতি ও স্বোচ্ছাচারিতার কারণে জেলায় শিক্ষার মান বৃদ্ধি না পেলেও বেড়েছে শিক্ষা অফিসারের অবৈধ অর্থের পরিমান। আর এ অবৈধ অর্থ সাদা করতেই গ্রামের বাড়িতে পুকুর দিয়ে মাছ চাষ, কবুতর ও উন্নত জাতের রামছাগল পালন, দেশী বিদেশী ফল চাষ, ছেলেকে দিয়ে ঢাকায় বড় ব্যবসা এবং কৃষি জমি ক্রয় করে চাষাবাস। এসব প্রজেক্টে ইতোমধ্যে লগ্নি করেছেন কয়েক কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে ডিজির প্রতিনিধি দেয়া, শাখা খোলা ও এমপিও সংক্রান্ত কাজে শিক্ষকদের কাছে ঘুষ নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানাযায়, বিগত ১৯৯৪ সালে তিনি চাকুরিতে যোগদান করে অল্প সময়ের মধ্যে তোষামদি ও তদবির করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব এবং পরবর্তীতে ২০০৫ সালে রংপুর ডিডি অফিসে ইন্সপেক্টর হিসাবে যোগদান এবং অলৌকিক ভাবে কিছুদিনের মধ্যে ডিডিথর চার্জ গ্রহন করেন। কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও চতুর এ কর্মকর্তা নেতাদের তোষামোদ করে কুড়িগ্রামে বদলী হয়ে এসে গত ০৬/১১/২০১০ থেকে ২৩/০৩/২০১৪ পর্যন্ত ৩ বছর ৫ মাস জেলা শিক্ষা অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।পরে নানা অনিয়মের অভিযোগে শাস্তিমুলক বদলী করে দীর্ঘদিন রংপুর ও ঢাকা অফিসে সংযুক্ত করে রাখা হয়। ফের তদবির আর টাকার জোড়ে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার হিসাবে পদায়ন করা হয় ০৬/১০/২০১৮ সালে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর ৬ মাস টানা একই কর্মস্থলে। অর্থাৎ দু দফায় কুড়িগ্রামে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত আছেন।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলমের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার চর খুনিয়ার চর এলাকার বকবান্ধা নামাপাড়া গ্রামে। তিনি নিজ জেলায় চাকরি করার সুবাদে প্রতিনিয়ত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বৃহস্পতিবার বাড়িতে যান এবং রবিবার এসে অফিস করার কথা থাকলেও অধিকাংশ দিনেই তাকে অনুপস্থিত থাকতে দেখা যায়। ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত দুই উপজেলা রৌমারী ও রাজিবপুরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের অজুহাতে তিনি রবিবারের এমনকি সোমবারও তার কুড়িগ্রামের অফিসে আসেন না।এনিয়ে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা গুঞ্জন ও ক্ষোভ। কেননা অনেক শিক্ষক দুর দুরান্ত থেকে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে যেতে হয়।
বকবান্ধা নামাপাড়া গ্রামে রাস্তার ধারে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫৫ শতক জমি ক্রয় করেন। এখানে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন বাড়ি ও খামার বাড়ি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের নানা স্থাপনা। চলতি বছর সায়দাবাদ বাজারে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বড় ছেলেকে দিয়ে চালু করেন ‘এস আর ব্রান্ড শপ। এছাড়া গ্রামের বাড়িতে রয়েছে কয়েক একর আবাদি জমি। রংপুরে বাড়ি এবং ঢাকায় ফ্লাট বাড়ি।
ইতোপুর্বে তিনি ২০১৬ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে মাউশির প্রতিনিধি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বকসী ঠান্ডা জানান,একজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিজের জেলায় দীর্ঘদিন থাকা দৃষ্টিকটু ব্যাপার। আর তার বিরুদ্ধে যে সব অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ও জেলা দুনীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ জানান,একজন শিক্ষা কর্মকর্তা দীর্ঘদিন এক অফিসে চাকরি করলে তার পরিধি বিস্তৃত হয়। ফলে যেকোন অনিয়ম ও দুর্নীতি করা সহজতর হয়। তার উপর এ কর্মকর্তা নিজ জেলায় ১০ বছর ধরে চাকরি করায় দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার স্বেচ্ছাচারিতা, অসৌজন্য আচরণ, শিক্ষদের মধ্যে গ্রুপিং ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা সহ নানা কারণে জেলার শিক্ষার মান উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
জেলা প্রবীন হিতৈষী সংঘের সভাপতি এবং স্কাউট ব্যক্তিত্ব এ কে এম সামিউল হক নান্টু বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ শুনেছি। সত্যতা তদন্ত করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। তবে তিনি জেলা স্কাউটের গ্রুপিংয়ের ইন্ধন যুগিয়ে সংগঠনটি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মজনুর রহমান বলেন, জেলা শিক্ষা অফিসার দুর্নীতিবাজ। টাকা ছাড়া কোন কাজ করেন না। তার দুর্নীতির সিন্ডিকেটের হোতা ফারুক,আব্দুল মালেক,আব্দুল লতিফসহ ৫/৬জন শিক্ষক। শামছুল আলম আমার কাছ থেকে নেফার দরগা উচ্চ বিদ্যালয়ের ডিজির প্রতিনিধি নেয়ার সময় উৎকোচের বাহানায় অভিযোগে একমাস টালবাহানা করেন।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমার বাবা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। চাচা বিএনপি করে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার বাড়ি কুড়িগ্রামে এটা সত্য। আমার সুনাম ধ্বংস করবার জন্য একটি মহল পায়তারা করছে।