২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের কর্মচারী,কিছু সংখ্যক চিহ্নিত দালাল ও ড্রাইভার থেকে মালিক ও দালাল দিয়ে ‘সিন্ডিকেট’ করে বেশি ভাড়া আদায় করেন। ভাড়ার ওপর কমিশনই ২০%। করছাড়ের সুফল নেই। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ভিতরে এবং মেইন গেটের সামনে সারি বেঁধে অলস দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বুলেন্সগুলো। রোগী পরিবহনে চাহিদা যতটা, তার চেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু রোগী পেলেই ভাড়া হাঁকা হয় অনেক বেশি। এর সাথে একযোগে চলে ভাড়া বিক্রি। ঢাকা বা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স গুলো রোগী নিয়ে নামিয়ে হাসপাতালের দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ৩থেকে ৪ হাজার টাকার বিনিময়ে দিয়ে ফিরতি ভাড়া নিয়ে ফেরত চলে যায়। কিন্তু রোগীদের কাছ থেকে নিয়মিত ভাড়াটা নেওয়া হয়। যেখানে দালাল সিন্ডিকেটের লাভ হয় অর্ধেকের ও বেশি। এ লাভের টাকা যোগ্যতা হিসেবে ভাগ করে দেওয়া হয় ঐই সিন্ডিকেটের অনান্য সদস্য ও ড্রাইভারের মধ্যে। এতে প্রতিনিয়ত ঠকছে সাধারণ মানুষ। এই দালাল সিন্ডিকেটের মূল হোতা জাবেদ ড্রাইভার। এই জাবেদের নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেক্টরে চলছে নোংরা রাজনীতি এবং মানুষ ঠকানোর মহাব্যবসা।
হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স না নিয়ে অন্য কোথাও থেকে কম টাকায় ভাড়া করবেন, সে সুযোগ নেই। হাসপাতাল কেন্দ্রিক ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট’ রোগীকে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই দেবে না। তাদের এক কথা, অন্য অ্যাম্বুলেন্স নিতে হলে তাদের টাকা দিতে হবে।
হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি পরিবহনসেবাকে ঘিরে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে বছরের পর বছর ধরে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় হাসপাতালের কর্মচারী, ড্রাইভার অথবা দালালদের । এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় ট্রিপ কমে গেছে। এ কারণে খরচ পোষাতে মালিকেরা রোগীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। এ ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকদের ঐক্য রয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষের জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা সহজ করতে সরকার কর ছাড় দিয়ে রেখেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক তালিকা অনুযায়ী, দেড় হাজার সিসি (ইঞ্জিন ক্ষমতা) পর্যন্ত একটি পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে মোট করভার ৩১ শতাংশ। একই ক্ষমতার একটি মাইক্রোবাস আমদানিতে কর দিতে হয় ১২৮ শতাংশের মতো। সরকার অবশ্য কর ছাড় দেওয়ার বাইরে আর কিছুই করেনি। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই।
কুষ্টিয়া অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির এক নেতা বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার কোনো তালিকা নেই। নেই সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও। যে যেভাবে পারছে, রাস্তায় সমানে অ্যাম্বুলেন্স নামাচ্ছে।’ তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে হাসপাতালগুলোর কর্মচারীদের (ওয়ার্ডবয়,আয়া ও দালালদের) ওপর। এ জন্য তাদের ভাড়ার অন্তত ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। এই কমিশন–বাণিজ্য না থাকলে ভাড়া অনেকটাই কমে যেত।
জেলা কেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেসরকারি একেকটি অ্যাম্বুলেন্স কুষ্টিয়ার ভেতর রোগী বহন করতে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে। ঢাকার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আশপাশের জেলায় যেতে হলে একজন রোগীকে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। একটু দূরের জেলার ক্ষেত্রে ভাড়া দিতে হয় দূরত্ব ভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
দৌলতপুরের রফিক আহমেদকে গত বৃহস্পতিবার
দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। ৪ ঘণ্টার রাস্তায় মনিরের স্বজনদের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে আট হাজার টাকা।
রফিকের স্বজন অনি হোসেন বলেন, ‘রোগী অসুস্থ। ঢাকায় আনতেই হবে। তাই ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করার সুযোগ ছিল না।’ সাড়ে আট হাজার টাকার বিনিময়ে ঢাকার একটি অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে কুষ্টিয়া পোস্ট অফিসের সামনে থেকে তুলে দেয় কয়েকজন। তিনি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা সংঘবদ্ধ। রোগীদের জিম্মি করে তারা সব সময় বেশি ভাড়া আদায় করে থাকে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই। সমস্যা হলো, সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারীদের যোগসাজশে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বসিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা বিশেষ বিশেষ রোগী পরিবহন করে।বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা রোগীর জরুরি কোনো পরিস্থিতি দেখলে জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে প্রতিনিয়তই।
মরিয়মের আত্মীয় সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘বোন বিষ পান করার পর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গিয়ে দেখি, কেউ চার হাজার টাকার কমে যাবে না। তাই কিছু করার ছিল না বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের নতুন গেটের সামনের রাস্তার উপর অবৈধভাবে অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন হাসপাতালের ভিতর ও সামনে একই চিত্র। এই স্ট্যান্ডগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী, গুটিকয়েক অ্যাম্বুলেন্স মালিক, ড্রাইভার ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।
খালিদ সাইফুল / দৈনিক দেশতথ্য / ৩১ ডিসেম্বর ২০২২