Print Date & Time : 11 May 2025 Sunday 1:04 am

কুষ্টিয়ার অন্যরকম বিনোদন হলো পুতুল নাচ

পুতুল নাচের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পাক হানাদার বাহিনী পিস কমিটি রাজাকার আলবদর আলশামস কিভাবে মুক্তিকামী জনতার উপর নির্যাতন করেছিল তা তুলে ধরা হয়েছিল।

কুষ্টিয়ার জনপদের বিনোদনে পুতুল নাচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। এক সময় রাত জেগে গ্রামের মানুষেরা ভিড় করে দেখতো পুতুল নাচ। পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরি করে, সেটাতে রঙ তুলির আঁচড় দিয়ে, বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়ে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুতার দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে পুতুল নাচ দেখানো হতো।

কুষ্টিয়ার ‘মনহারা’ পুতুল নাচের যৌবনে দীপ্তমান কদর থাকলেও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে আজো বিশেষ কোন আয়োজন ও গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে প্রদীপের মতো টিপ টিপ করে বেঁচে আছে দেশের বিখ্যাত ‘মনহারা’ পুতুল নাচ। এই দলের পুতুল নাচ দেখলে সত্যিই যে কারও মন হারিয়ে যায় তা না দেখলে বিশ্বাস করা দায় তো বটেই।

কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে ঘোষণা করা হয়েছিল তিন দিনের আনন্দ উৎসব। সেই আয়োজনের সমাপনী দিনে দেখানো হয়েছে কুষ্টিয়ার ঐতিয্যবাহি পুতুল নাচ। সুরম্য নতুন ভবনে পুতুলনাচের দৃশ্য এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।

এই পুতুল নাচের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর কু-কর্ম, পিস কমিটির চেয়ারম্যান, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কিভাবে মুক্তিকামী জনতাকে নির্যাতন করেছিল তা তুলে ধরা হয়েছিল।

কুষ্টিয়ার ‘মনহারা’ পুতুল নাচের প্রধান কৌশলীর নাম আব্দুল কুদ্দুস। দৈনিক দেশতথ্যের প্রতিবেদকের সাথে  শিল্পকলা একাডেমীতেই কথা হয়। আব্দুস কুদ্দুস কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের মৃত সলিম মালিথার ছেলে। জীবনের প্রায় সবটুকু সময় ব্যয় করে দিয়েছেন এই মনহারা পুতুল নাচের সঙ্গে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই পুতুল নাচের দলের হাল ধরে রেখেছেন। আজো স্বপ্ন দেখেন, পুতুল নাচের সুদিন ফিরবে। নিজ হাতে এখনো তৈরি করে যাচ্ছেন বিভিন্ন পালার জন্য পুতুল।

আব্দুস কুদ্দুস দেশতথ্যকে বলেন, ‘১৯৬৫ সালে আমার বয়স ৯-১০ বছর। আমার বাবা খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন গান-বাজনা শেখানোর জন্য ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলে নিয়ে যান। সেখানে শুকচান মাল নামের একজন ওস্তাদ ছিলেন। আমি তার কাছে কয়েক ধরে পুতুল নাচের বিভিন্ন গান শিখি। আমার চেহারা ভালো হওয়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে শাড়ি পরিয়ে পুতুলের সঙ্গে নাচ-গান করাতেন। প্রায় ১৬ বছর পুতুল নাচের আসরে পুতুলের সাথে মেয়ে সেজে গান করেছি। ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান করলে আমি ৫০-১০০ টাকা পেতাম।

‘১৯৭২ সালে মনহারা পুতুল নাচের দলটির দায়িত্ব আমি পাই। তখনো ওস্তাদ আমার সাথে থাকতেন। তারপর ওস্তাদ শুকচান অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। দলে দুর্দিন নেমে আসে। আমাদের পুতুল নাচের দলে ছিল ১৪ জন সদস্য। এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতো। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতো আর গান গাইতো। ১৯৭৫ সালে কুষ্টিয়া শিল্পকলা থেকে আমি হারমনিয়াম বাজানোর প্রশিক্ষণ নেয়। তারপরে দলের দুর্দিন প্রায় কাটিয়ে উঠি। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতাম। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের পুতুল নাচ। কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুল নাচ করে বেশ সুনাম অর্জন করি।’

কুদ্দুস জানান, কুষ্টিয়ার বাইরে চুয়াডাঙ্গায় ‘রাজকণ্যা মনিক মালা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘রুপবান’, ‘গরীবের ছেলে’, ‘গরীবের মেয়ে’, হিংসার পরিনাম’ এবং মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, রাজশাহী, নড়াইল, ঢাকায় ‘প্রেম সার্থক’ ও ‘কালো গাজী’ এর পুতুল নাচের পালা করেছেন তিনি। ঢাকার শিল্প কলায় ‘ঘুনাই সুন্দরী’ পালা করেছেন।

এ ছাড়াও তিনি পুতুল নাচে সাপ, নৌকামাঝি, কুমার, মাছ, বাঘ, হুনুমান, হরিণ, ঘোড়া প্রভূতি বিষয় নিয়ে গ্রাম্য জীবনভিত্তিক হাসি-ঠাট্টা ও তামাশামূলক গল্পে রচিত পুতুল নাচ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্যবার দেখিয়েছি। আমার এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘সোনার যাদু’ ও ‘রুপবান’। এ ছাড়াও ‘সাগর ভাষা’, ‘ফেরারি সম্রাট’, ‘নাচ মহল’, ‘ভিখারির ছেলে’ অন্যতম পালা।

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৭ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে পুতুল নাচ প্রতিযোগিতায় আমি ও আমার দল অংশগ্রহণ করি। সেখানে সারা দেশের ৪৮টি পুতুল নাচের দলের মধ্যে আমি প্রথম হই। এ ছাড়া ২০১৩ সালে এবং ২০১৬ সালেও আমি পুরস্কার গ্রহণ করি। পুতুল নাচ বাংলার মানুষের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য।

এই পুতুল তৈরি করতে যেমন অর্থের প্রয়োজন তেমনি এই নাচ-গান পরিচালনার জন্যেও অর্থের প্রয়োজন। তবে বর্তমানে অশ্লিল নাচ গানের কারনে এই গান করতে নানান বাধার সম্মুখিন হতে হয়।’

‘প্রশাসন আমাদের প্রোগাম করার অনুমতি দেয় না। কারণ বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় পুতুল নাচের নামে বিভিন্ন ব্যক্তিরা অশ্লীল নাচ গান করায়।

আমাদের এই মনহারা পুতুল নাচ দেখতে এখনো অনেক মানুষ ভিড় করে। দলটিতে খুব কষ্টে টিকিয়ে রেখেছি। সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া আর কতদিন এভাবে টিকে থাকবে ঐতিহ্যবাহী এই ‘‘মনহারা’’ পুতুল নাচ। তবে আমি যতদিন বেঁচে আছি এই পুতুলের সাথেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো। মানুষের মনে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করবো।’

জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আমিরুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার কুষ্টিয়ায় দৃষ্টিনন্দন অত্যাধুনিক শিল্পকলা একাডেমী নির্মাণ করায় আমরা তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসবের আয়োজন করি। আজকে (বুধবার) আনন্দ উৎসবের সমাপনী দিনে মনোহরা পুতুল নাচ দর্শকদের জন্য দেখানোর ব্যবস্থা করেছি।

তিনি আরও বলেন, মিরপুর উপজেলার ‘মনহারা’ পুতুল নাচ জেলার মধ্যে তথা সারা দেশেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আব্দুস কুদ্দুস তিনি এই দলটিকে ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন স্থানে গ্রামের মানুষের মাঝে পুতুল নাচের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিনোদন দিচ্ছেন। এই পুতুল নাচ যেন আব্দুল কুদ্দুস টিকিয়ে রাখতে পারে এজন্য শিল্পকলা থেকে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি। 

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//জুন ১৬,২০২২//