এনামুল হক , কুষ্টিয়া : বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু হানিফকে নিয়ে চক্রান্ত থামছেই না। ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের সহকারী কমান্ডার হিসেবে বিজয়ী এই মুক্তিযুদ্ধাকে ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি মোট পাঁচবার অভিযুক্ত করা হয়। নিজ এলাকার কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ তুলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) নালিশ করে। আগের চারটি অভিযোগের তদন্ত ও শুনানিতে শেখ আবু হানিফ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সম্মেলন কক্ষে বহুবার নিজের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন- যেখানে প্রত্যেকবারই উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পক্ষে ব্যাপক সাক্ষ্য প্রমাণ থাকার ফলে আগের চারটি অভিযোগ থেকে তিনি খালাশ পান। কিন্তু সম্প্রতি আরও একটি চক্র একই অভিযোগে উপযুক্ত দুটি দফতরে আবারও নালিশ করে। চলতি মাসের ১২ তারিখ শেখ আবু হানিফকে পুনরায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জামুকা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তিনি যথারীতি লিখিতভাবে জবাব দিয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন যে, যারা বারংবার তার বিরুদ্ধে মিথ্যে ও বানোয়াট অভিযোগ দায়ের করছে তাদের বিরুদ্ধে যেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
শেখ আবু হানিফের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে বটতৈল নামক স্থানে। জন্ম ১৯৫৫ সালের ১২ই জুন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ১৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ২০০৫ সালে প্রণীত গেজেটের ৯৮ নম্বর সিরিয়ালে তার নাম রয়েছে। তার মুক্তিযোদ্ধা নাম্বার ০১৫০০০০২৭৭১। ২০১২ সালের ১৮ জুলাই তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক সনদ লাভ করেন এবং দীর্ঘ বছর ধরে ‘ক’ ক্যাটাগরির একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসিক ভাতাসহ সরকারের সকল সুবিধাদি ভোগ করে আসছেন। ২০১৭ সালে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে ‘ক’ ক্যাটাগরির মুক্তিযোদ্ধার যে তালিকা করা হয় তাতে শেখ আবু হানিফের নাম এক নম্বরে রয়েছে। বটতৈল-আলামপুর ইউনিয়ন তালিকাতেও তাকে এক নম্বরে পাওয়া গেছে। এমনকি কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা তালিকাতেও তার নাম রয়েছে সবার উপরে।
শেখ আবু হানিফ ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে টিউবওয়েল প্রতীক নিয়ে ২০৮ ভোট পেয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা ইউনিট কমান্ডের সহকারী কমান্ডার নির্বাচিত হন। ভোটার তালিকায় তিনি ২৫৯ নাম্বার ভোটার। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় যতগুলো বধ্যভূমি রয়েছে সেখানে জাতীয় দিবসগুলোতে পুষ্পমাল্য অর্পন ও অনুষ্ঠানাদি আয়োজনের নিমিত্তে যেসব উপকমিটি রয়েছে তার সবগুলো উপকমিটিতে তিনি দীর্ঘ বছর ধরে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি কুষ্টিয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩০ মার্চ প্রশিক্ষণের উদ্দেশে ভারতের শিকারপুরে চলে যান। শিকারপুরের যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে চলে আসেন কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সম্মুখ সমরে তিনি যুদ্ধ করেন এবং ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত দিবসে তিনি বটতৈল ক্যানেলের বিধ্বস্ত সেতুর নিকট অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সশরীরে উপস্থিত থেকে বিজয় উদযাপন করেন। এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করেন বটতৈল গ্রামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, শেখ আবু হানিফ ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন সম্মুখ সমরের যোদ্ধা। বটতৈল গ্রামের আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু হানিফের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। কিছু মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা কারোর নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তার নিকট থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিতে চায়।
শেখ আবু হানিফের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রশিদের বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের চিলমারীর চরে। তিনি ঐ এলাকাতেই যুদ্ধ করেছিলেন বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১০ বছর পরে তিনি কুষ্টিয়ার খাজানগরে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে তখন তিনি কিভাবে জানেন যে শেখ আবু হানিফ মুক্তিযুদ্ধ করেননি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কেবলই আমতাআমতা করতে থাকেন। আবু হানিফের বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগকারী খাজানগর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আজগর আলী একজন মাদকসেবি ও মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত একাধিক মামলা রয়েছে এবং তিনি একাধিকবার জেলও খেটেছেন। খাজানগরের মিঠুন ও মরহুম মুক্তিযোদ্ধা আজিজ ফকিরের স্ত্রী শাহিনাকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় করে দেয়ার কথা বলে তাদের নিকট থেকে ১০ হাজার করে টাকা নেন। কিন্তু পরবর্তীকালে আজগর আলী মিঠুন ও শাহিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রশিদ ও আজগর আলী আরও বহু লোকের নিকট থেকে মুক্তিযোদ্ধা করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মর্মে অভিযোগ আছে। আজগর আলী দাবি করেন শেখ আবু হানিফ একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।
এর আগে শেখ আবু হানিফের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে আমিনুর রশিদ ও আজগর আলী গং। হাইকোর্টের রিট চলমান থাকা অবস্থায় আবার কেন একই অভিযোগ নিয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নতুন করে অভিযোগ দায়ের করতে হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে আজগর আলী বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সকল সেক্টরে নতুন দায়িত্বশীল এসেছে তাই তাদেরকে নতুন করে অবহিত করেছি।
এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক ও কুষ্টিয়া জেলাপ্রশাসক তৌফিকুর রহমানের নিকট জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যেহেতু হাইকোর্টে রিট আছে তাই এ ব্যাপারে তার বলার কিছু নেই- বিষয়টি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ও আদালতের এখতিয়ার।