কুষ্টিয়ায় বছরের পর পর বছর ধরে চলছে অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধ ইট ভাটাগুলো প্রকাশ্যে ইট তৈরী করছে। অভিযোগ রয়েছে সংশ্লীষ্টদের নানাভাবে ম্যানেজ করে এসব ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির মাটি ও কাঠ। যা পরিবেশের উপর হুমকিতো বটেই।
ইট ভাটার দূষিত গ্যাস, তাপ ও ছাই আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছেন কৃষকসহ শিশু ও বয়স্করা। একইসাথে ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমির।
সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী, জেলায় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে যথাযথ নিয়ম মেনে লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক ছাড়পত্র নিতে হয়। জেলা প্রশাসন ইটভাটা স্থাপনে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক ইতিবাচক ছাড়পত্র আছে কিনা সে বিষয়টি দেখেন।
তবে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের তথ্য মতে কুষ্টিয়া জেলায় ১৪৯টি ইটভাটার মধ্যে মাত্র ১৭টি বৈধ। বাকি ১৩২ টি বছরের পর বছর ধরে নির্দ্বিধায় কাজ করে যাচ্ছে। নামমাত্র দু-একটি কয়লার ভাটা থাকলেও বাকিসব চলছে গাছ পুড়িয়ে।
উদ্যোক্তারা কয়লার ভাটা বন্ধ রেখে লাগামহীনভাবে গাছ পুড়িয়ে ইট ভাটা চালাচ্ছেন। কোনো কোনো ইটের ভাটাতেই বসানো হয়েছে স’মিল কল। প্রতিনিয়ত এসব ভাটায় ইট পোড়াতে বড় বড় গাছের গুঁড়ি এইসকল স’মিলে চিরে ভাটায় ফেলা হচ্ছে। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলায় ইটভাটা ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা যাবে না, অথচ এসব অবৈধ ইটভাটা দিনের পর দিন অবাধে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপন করার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের ঢাকা থেকে আসা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দল কয়েক কোটি টাকা জরিমানা আদায় করার ফলে ভাটাগুলোয় এখন প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি করা হয়েছে।।
কয়েকটি ইটভাটাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ইট পোড়াতে বড় বড় গাছের গুঁড়ি জড়ো করা হয়েছে। ভাটায় কর্মরত এক শ্রমিক বলেন, প্রতি চার লাখ ইট তৈরিতে ২০-২২ দিন সময় লাগে। এতে প্রায় ৩৫ হাজার মণ কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আগে দূর থেকে কাঠ চিরে আনা হতো, এতে সময় ও অর্থ বেশি ব্যয় হতো। যে কারণে ভাটামালিক নিজেই এখন করাত বিশিষ্ট স’ মিল স্থাপন করেছেন।
এ বিষয়ে ভাটামালিক খয়বার প্রামাণিক বলেন, তার ভাটার সব কাগজপত্র ঠিক নেই। তবে সবাই যেভাবে চলছেন, তিনিও সেভাবেই চলছেন। এ এলাকাতে একাধারে ১০টি ভাটা রয়েছে, তারা সবাই জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে।
গত ৬ জানুয়ারি ভ্রাম্যমাণ আদালত এসএসবি এবং কেবিপি ভাটার চিমনি ভেঙে দিয়ে যায়। সেগুলো মেরামত না করেই টিন দিয়ে চিমনি বানিয়ে আবারো ইট পোড়ানো হচ্ছে।
বারখাদা উত্তরপাড়ায় দুটি ভাটার মালিক আলাল উদ্দিন। দলীয় কোনো পদে না থাকলেও তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দেন। এলাকায় তার প্রভাবও রয়েছে। প্রায় ১০০ বিঘা আবাদি জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন এনবিসি এবং এএসএসবি ভাটা। সেখানেও বসানো হয়েছে স’ মিল।
কুষ্টিয়া নাগরিক কমিটির সভাপতি প্রফেসর ডা. এসএম মুসতানজিদ বলেন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। এজন্য তিনি কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা তা জানা যায়নি।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসিবুশ শাহীদ বলেন, ইটভাটার চুল্লি নিচু হলে মানুষ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধোঁয়ায় গাছ, ফলমূল ও ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কয়লা থেকে ব্যাপকভাবে কার্বন মনোক্সাইড নির্গত হওয়ায় মানুষ সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হাবিবুল বাসার বলেন, আমরা অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের সাধ্যমত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। লোকবল সংকটের কারণে নিয়মিত না পারলেও অভিযোগ পেলে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে। দেশ ও পরিবেশ রক্ষায় কাঠ ব্যবহার করে ইট ভাটা চালানো যে কোন মূল্যে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ১৭ এপ্রিল ২০২৩

Discussion about this post