কুষ্টিয়ায় যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা অবৈধ ক্লিনিক গুলি প্রসুতি মায়েদের মৃত্যু ফাঁদে পরিনত হয়েছে। অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল গুলি চিকিৎসা সেবা কে কেবলমাত্র মুনাফা আয়ের সহজ পথ হিসেবে নেয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। চিকিৎসার নামে জীবনহানি নিত্যদিনের ঘটনা হলেও প্রতিকারে দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যত: কোন দৃষ্টান্ত মূলক পদক্ষেপ না নেয়াকে দুষচেন ভুক্তভোগীরা। একের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও এসব ক্লিনিক বন্ধে দায় নিচ্ছে না কেউ। অবৈধ সিজারে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনায় মায়ের স্পর্শ বি ত এতিম শিশুর মিছিল দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে ৬৩১২টি জীবিত শিশু জন্মদিতে গিয়ে প্রসবকালীন সময়ে ৭জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে প্রসবকালীন সময়ে প্রসুতি মায়ের মৃত্যু সংখ্যা ২৫জন থাকলেও ২০২২ সালে এসংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৭ জনে। এসব মৃুত্যুর ঘটনার ৯০%ভাগই ঘটেছে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলিতে। ভুল চিকিৎসা বা অবহেলা জনিত কারনে এসব মৃত্যু ঘটেছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিযোগকে ভিত্তিহীন মনে করছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে এবছরের ১৩ জুন পর্যন্ত সময়কালে সংঘটিত মাতৃ মৃত্যুর ঘটনাগুলি অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন ক্লিনিকে ঝরে যাওয়া ৮ জন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটনার পর্যালোচনায় জেলার স্বাস্থ্য সেবার ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এরা সবাই অদক্ষ ও অপেশাদার ভুয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে কথিত সিজারের শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সদ্যজাত শিশুকে রেখে নিহত হয়েছে। অপর একজন প্রসুতি শিশুসহ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে বলে অভিযোগ পরিবারের।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, এবছরের ৩ জুন কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে ‘নাহার ক্লিনিকে’ সদর উপজেলার দোস্তপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শিল্পী খাতুন (২২) নামের এক প্রসূতি অদক্ষ ভুয়া নার্সের হাতে সিজারের শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। অভিযোগ আছে এই নাহার(প্রাঃ) ক্লিনিকে সার্বক্ষনিক ডাক্তার হিসেবে ডা. আক্তারুজ্জামান ফিরোজ নামে যিনি কাজ করেন তিনি কার্যত: একজন মাদকাসক্ত ভুয়া ডাক্তার এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে মিরপুর থানা পুলিশের হাতে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামিয়া এন্ড ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল নামে একটি অবৈধ ক্লিনিকের ওয়ার্ডবয় এবং আয়া মিলে সদর উপজেলার বটতৈল গ্রামের জহুরুল ইসলামের স্ত্রী রিমা খাতুন(২৮) নামে এক প্রসুতির স্বাভাবিক ডেলিভারী করাতে গিয়ে টেনে হিচরে শিশুটিকে বের করতে পারলেও প্রসুতির ইউটেরাস ছিড়ে ফেলায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে ওই প্রসুতি রিমা খাতুনসহ শিশুটি নিহত হয়। একই ভাবে ২মার্চ ভেড়ামারা ‘সাদিয়া ক্লিনিকে’ নাসিমা নামের প্রসুতি, ২০২১ সালের ৯জুনে কুষ্টিয়া সনো হাসপাতালে নাসরিন নাহার রিপা(২১) নামের প্রসুতি, ২০২১ সালের ০১ অক্টোবর কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সেবা ক্লিনিকে তুলিকা বেগম (২৫), ২০২০ সালের ০১ আগষ্ট কুমারখালি বাঁশগ্রামের আকবরের স্ত্রী তানিয়া খাতুন(২২) কুষ্টিয়া ইসলামিয়া হাসপাতালে, ০১ সেপ্টেম্বর কুমারখালি উপজেলার সোন্দাহ গ্রামের শাপলা খাতুন (২২) কুষ্টিয়া শহরের কাষ্টম মোড়স্থ শাপলা ক্লিনিকে এবং একই বছর ০৯ মার্চ কুষ্টিয়া শহরের পেয়ারাতলায় ‘পদ্মা প্রাইভেট হাসপাতালে’ কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের আব্দুর রশিদের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন(২৪) নামের প্রসুতি মায়ের অবৈধ সিজারিয়ানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ এসব পরিবারগুলির। এই সবগুলি প্রসুতিই সদ্যজাত শিশুকে এতিম করে মৃত্যু বরণ করেন।
এবিষয়ে স্বাচিপ ও বিএমএ নেতা ডা. আমিনুল হক রতন মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘প্রসুতি মায়েদের চিকিৎসা বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্কতা জরুরী। সামান্যতম অবহেলা জনিত কারণে প্রানহানির কারণ হতে পারে। জেলার বিভিন্ন অবৈধ ক্লিনিকগুলিতে মা ও শিশুর যথাযথ পরিচর্যা ও চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই কার্যত: নাই। অথচ কিছু অসচেতন রোগীরা সেখানে গিয়ে নানা ভাবে প্রতারিত হচ্ছে বলে আমরা জানি। এসব নিরসনে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও দায়িত্বশীল ও যতœবান হওয়া জরুরী’।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘চিকিৎসায় অবহেলা জনিত কারণে প্রসুতি মায়ের মৃত্যু ঘটনার সংবাদ পেলেই আমরা সেখানে ছুটে যাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও পাই। সেক্ষেত্রে ক্লিনিক বা হাসপাতাল বন্ধের সুপারিশ করি। সর্বশেষ মিরপুর উপজেলার পোড়াদহে ‘নাহার ক্লিনিকে’ চিকিৎসা অবহেলায় শিল্পী খাতুন নামের প্রসুতির মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে ওই ক্লিনিকের জন্যই। ওদের এজাতীয় চিকিৎসা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় কোন আয়োজন ও অনুমোদন কোনটাই নেই’। এসব ক্ষেত্রে রোগীদেরও সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন এই সিভিল সার্জন।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ২৫ জুন ২০২৩

Discussion about this post