উব্ধৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদনের জেলা কুষ্টিয়ার কৃষিতে চলছে ত্রাহি অবস্থা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তীব্র খরতাপের সাথে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ ও সেচ সংকট। চলতি বোরো মৌসুমে মাঠের ধান চাষ নিয়ে এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন জেলার কৃষক ও কৃষিবিদরা। বিষয়টি জেলার উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভাতেও গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে ধার্য থাকলেও সর্বশেষ ধান চাষে অর্জিত হয়েছে ৩৬ হাজার ৩শ হেক্টরে লক্ষমাত্রার উদ্ধৃত্ত হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে প্রতি হেক্টর জমিতে গড় ধান উৎপাদন লক্ষমাত্রা ৬দশমিক ৫মে:টন এবং চালের হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা ৪ দশমিক ২ থেকে ৪ মে:টন।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আনিসুর রহামান জানালেন, ‘উপজেলায় বোরো আবাদ হচ্ছে ১০ হাজার ১শ ৩৪ হেক্টর জমিতে। সরেজমিন ধানের মাঠের অবস্থা এখন খুবই সংকটাপন্ন এবং ফলন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মাঠে মোট ধানের মধ্যে অর্ধেক ধানের পেটে এখন ফুল ভর্তি আর অর্ধেকের দুধেল অবস্থা। এসময় এসব ধানের মাঠে সার্বক্ষনিক পানির যোগান থাকা অতি জরুরী। কিন্তু চলমান তীব্র তাপদাহ এবং জিকের সেচ সরবরাহ একেবারে তলানীতে পড়ে আছে। এমনকি যেসব চাষীরা নিজেদের মতো করে শ্যালো স্থাপন করে জমিতে সেচ দিতো তারাও এখন বিদ্যুৎ সংকটের মুখে ঠিকমতো পানি দিতে পারছে না জমিতে’। এভাবে আর কিছুদিন চলতে ব্যাপকভাবে ফসলহানির ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।
আমলা গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলামের অভিযোগ, ‘অনেকদিন ধরি জিকি(জিকে) খালের পানি তলানিতে। পাশ আইলির জমিতি শ্যালো বোরিং থে পানি নিয়ি আড়াই বিঘে ধান লাগাইছি। আমার ধান এখন পুরা পোয়াতি(গর্ভবতী)। একদিন পানি না দিলিই মাঠ শুকায়ে যায়, যে খড়ানি চলছে, শ্যালো থেকে পানি দেবো, তাও দিতি পারছি নে, গত তিনদিন ধইরি কারেন (বিদ্যুৎ)নাই। শ্যালোও চলছে না। ইবার যে কোন বিপদে আল্লাহ ফেলবিনি কিছু বুঝছিনে’।
দৌলতপুর উপজেলার ধান চাষী শরিফুল সেখ বলেন, ‘আমাদের এখানে জিকের পানি নেই। একটা নির্দিষ্ট দুরত্বের ভিত্তিতে বিএডিসি গভীর নলকুপ স্থাপন করে মাটির নীচে লাইন করে জমিতে পানি দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ ঠিকমতো না পাওয়ায় মটর চলছে না। পানিও পাচ্ছিনা’। একেবারে ভরা মৌসুমে পানি বিনে ধান কিভাবে হবে আল্লাহ মালুম’। এভাবে চলতে থাকলে আমার ধান বাঁচাতে আবার ডিজেল ইঞ্জিনের শ্যালোতে পানি তুলতে হবে’।
কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার এস এম নাসির উদ্দিন বিদ্যুৎ ঘাটতির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘দেখুন এটা জাতীয় ভাবেই বিদ্যুৎ ঘাটতি চলছে, জেলার কৃষি অধ্যুষিত সমস্ত এলাকাটাই পল্লী বিদ্যুতের আওতায়। কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুতের মোট চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও নীচে নেমে এসেছে সরবরাহ। আমাদের গড় চাহিদা ১ শ ১৫ মে:ওয়াট হলেও সরবরাহ পাচ্ছি ৬০ মে:ওয়াটের নীচে। একদিকে তাপদাহের কারনে বিদ্যুতের অতিরিক্ত চাহিদা বেড়ে গেছে অন্যদিকে সরবরাহ ঘাটতির কারণে উভয় সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে’।
দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প গঙ্গাকপোতাক্ষ বা জিকে সেচ সরবরাহের ঘাটতির সত্যতা জানিয়ে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, ‘জিকে পাম্প হাউজের তিনটি পাম্পের মধ্যে দুইটি পাম্প বিগত ৬ বছর ধরে অকেজো হওয়ায় পাম্প হাউজের একটি পাম্প চালিয়ে চাহিদা পূরনের সুযোগ নেই। আমাদের সেচ সরবরাহ অ লের জন্য ১৪শ কিউসেক পানির সরবরাহ করার সক্ষমতা থাকলেও পদ্মা নদীর পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং একটি মাত্র পাম্প চালিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫শ কিউসেক পানি তুলতে পারছি। সেই সাথে তাপদাহের কারণে পানির প্রবাহ বেশি দুর পর্যন্ত চলমান রাখা যাচ্ছে না’।
কৃষি সম্প্রসারণ অর্ধিদপ্তর খামার বাড়ি কুষ্টিয়ার উপ পরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, ‘তীব্র তাপদাহে চলতি বোরো মৌসুমের ধান উৎপাদনকে রক্ষা করতে সোমবার কুষ্টিয়া জেলার উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভাতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগ ও জিকে পাম্প হাউজকে অধিকরতর সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে’। সেই সাথে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকেও বাড়তি তদারকি করা হচ্ছে’।
কুষ্টিয়ায় টানা ১১ম দিনে তীব্র তাপদাহে তথ্য জানিয়ে কুমারখালী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: সাইদুর রহমান জানান, ‘কুষ্টিয়াসহ আশপাশের তাপমাত্রা প্রতিদিনই ৪০.৫ ডিগ্রির উপর দিয়ে যাচ্ছে। গত শনিবার ছিলো ৪১ ডিগ্রি, সোমবার দুপুর আড়ায় টায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আজও পর্যন্ত সহসা পরিস্থিতির উন্নতির কোন আভাস পাওয়া যায়নি’।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ১৭ এপ্রিল ২০২৩

Discussion about this post