Print Date & Time : 12 May 2025 Monday 6:29 pm

গ্রামে এখন শহরের আমেজ

সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাট: দেশের প্রতিটি গ্রামে এখন শহরের আমেজ। দরিদ্রপ্রীড়িত জেলা লালমনিরহাটে খড়ের ঘর চোখে পড়েনা। পাল্টে গেছে গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র। শহরের মত গ্রামে এখন বহুতল ঘর বাড়ি। আধা পাঁকা বাড়ি ঘর চোখে পড়বে। খড়ের ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গ্রাম এখন শহরে পরিনিত হয়েছে। শহরের মত পাকা রাস্তা ঘাট, বিদুৎ, ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক এখন সব গ্রামে চলে এসেছে। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র ও ভূমি অফিস হতে ডিজিটাল সেবা ঘওে বসে পাচ্ছে মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের গ্রাম হবে শহর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পুরন হয়েছে। এখন পুরো বাংলাদেশ একটি শহুরে গ্রাম। গ্রাম এখন শহর। শহরের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রামের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
ভুমি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদের সেবা এখন ডিজিটাল প্লাটফর্মে ঘরে বসে পাচ্ছে গ্রামের মানুষ। সরকারের সকল সেবার খবর ওয়েব সাইর্ডে রয়েছে। সাধারণ মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, টিসিবির কার্ড, জমির পর্চা, খাজনা, খারিজ, খতিয়ান, জাবেদা, নাগরিকত্ব, চারিত্রিক সনদ সব সেবা শহরের মত ঘরে বসে পাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম কখনো বুঝতে পারবে না প্রকৃত গ্রামীণ পরিবেশ কেমন ছিল। গেঁও শব্দটির এখন যথার্থতা এখন গ্রামে নেই।
বর্তমান সরকারের আমলে গ্রামের মানুষের স্থায়ী অর্থনৈতিক সক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়েছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় পারিবারিক চাহিদা মোকাবিলায় তাই প্রমাণ করেছে। গ্রাম ও শহরের অর্থনৈতিক পার্থক্যের দুরত্ব কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। শ্রমজীবি দিনমজুর শ্রণি এখন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী। এভাবে এখন শহরের মত গ্রামেও কর্মক্ষেত্র বেড়েছে।
কয়েক বছর আগেও শীত মৌসুমে নতুন ধানের নাড়ায় (খড়ের আঁটি) গ্রামে ঘরের ছাঊনি ও নতুন খড়ের ঘর নির্মাণের ধূম পরে যেত। এখন গ্রামে কোথাও খড়ের ঘর চোখে পড়ে না। খড়ের ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খড়ের ঘর এখন গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হিসেবে শহরে স্থান করে নিয়েছে বিত্তশালী পরিবার ডেকোরেশনে কাজে। খড়ের ঘর ব্যবহার করছে পাকা ঘরের ডেকোরশনে।কয়েক বছর আগেও স্বল্প মূল্যে বাঁশ খড় দিয়ে ছাঊনি ও বেড়া নির্মাণ করে নতুন ঘর তৈরি করা হত। এই সব ঘরের নাম ছিল কুঁড়ে ঘর। নিম্ন শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ খড়ের ঘরে বসবাস কত।
মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির পরিবার খড়ের ঘর বাড়ির বাহিরে উঠানে বৈঠকখানা বা নাকারি ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যেত। স্বল্প আয়ের মানুষেরা খড়ের চালা ও খড়ের বেড়া ব্যবহার করত সাদামাটা ভাবে। বিত্তবান পরিবার গুলো খড়ের ঘরের ছাদ দিত কিন্তু বেড়া দিত বাঁশের বা কাঠের। এসব বাঁশের বেড়ায় থাকত নানা শৈল্পিক বাঁশ – মাঠের হাতের কারুকাজ। খড়ের ঘরের জায়গায় টিনের ছাদ ও টিনের বেড়ার ঘরের প্রচলন হয়ে গেছে । এখন গ্রামের ইটের ঘরের প্রচলন হয়ে গেছে। প্রতিটি গ্রামে এখন ইটের ভাটা দেখা যায়। কোন কোন গ্রামে তো এখন বহুতল ভবন চোখে পড়ে। পাঁকা ইটের বাড়ির স্বাভাবিক ঘটনা।

৯০’ র দশকে গ্রামে সাধারণত কুঁড়ের ঘর ছিল সব গ্রামে। ইটের কিংবা টিনের ঘর ছিল শহরে। এর প্রধান কারণ গ্রামের অর্থনৈতিক চিত্র ছিল কৃষি খাত ও কৃষি নির্ভর। গ্রামে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের বসবাস ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নাজুক। পরিবহন ব্যবস্থা ছিল অযান্ত্রিক। গ্রাম হতে শহর কে খুব দুরে মনে হত। এখন চিত্র পাল্টে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল-পরিবর্তন হয়েছে। তৈরি হয়েছে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যান্ত্রিককরণ হয়েছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। টিন, ইট, সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য হয়েছে। কালে আবর্তে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র এখন গ্রামে।

২০০৮ সালের পর সরকারে দূরদর্শিতা, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে সরকার নানা উদ্যোগ নেয়। এর ফলে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। যার প্রধান সূচক গ্রাম হতে কুঁড়ে ঘর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন চোখে পড়ে না কুঁেড় ঘর। এখন টিনের ছাদ ও টিনের বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ চোখে পড়ে। খড়ের চেয়ে টিনের ঘর নির্মাণ ব্যয় কম। বরং খড়ের ঘর নির্মাণ খরচ অনেক বেশী পড়ে যায়। খড়ের ঘর টিকসই কম হয়। টিনের ঘরের টিকসই বেশী হয়। টিনের ঘরের চেয়ে খড়ের ঘর অনেক আরাম দায়ক ও পরিবেশ বান্ধব হয়। খড়ের ঘর কে প্রাকৃতি এসি রুমের ঘর বলা হয়ে থাকে। খড়ের ঘর গরমের দিন ঠান্ডা ও ঠান্ডার দিন গরম থাকে। সাধারণত বাহিরে আবহাওয়া হতে ৪/৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার হেরফের হয়ে থাকে।
গ্রাম শহর হয়ে যাওয়ায় সহজলভ্য খড়ের দাম এখন ধানের চেয়ে দামী পণ্য। এক মন শুকনো ধান কুড়ি টাকা কেজিতে পাওয়া যায়। এক মন শুকনো খড়ের দাম ২৪০০ টাকা। খড় এখন শুধু গো খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয় তা কিন্তু নয়। এখন খড় পারটেক্স শিল্পের কাঁচা মাল হিসেবে ব্যবহার হয়। ব্যবহার হয় হস্ত শিল্পের আসবাবপত্র তৈরির শিল্প হিসেবে।
এদিকে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল গ্রাম হবে শহর। সেই গ্রাম শহরে পরিনিত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে। বেড়েছে বাসস্থানের ও খাদ্যের জন্য ব্যয়ের সক্ষমতা। এই গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গ্রাম হতে বিতাড়িত হয়ে গেছে কুঁড়ে ঘর। সেই জায়গায় এখন টিন ও ইটের ঘর চোখে পড়ে। গ্রামে যেমন খড়ের ঘর এখন নেই। তেমনি প্রতিটি গ্রামে শতভাগ বিদুৎ পৌঁছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক পৌঁছে। পাঁকা এলজিইডির রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামে সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার কমিউনিটি স্বাস্থ কেন্দ্র। শতভাগ স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। এখন শহরের আমেজ গ্রামে। গ্রামের হাট বাজারে পাওয়া যায় অত্যাধুনিক সব ধরনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। সকল প্রকার ব্যবহারিক ইলেক্ট্রনিক পণ্য টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, মাইক্রো ওভেন, গ্যাস সিলিন্ডা, গ্যাসের চুলা, নানা ধরনের দেশী-বিদেশী প্রসাধনী, দেশী-বিদেশী ফলমূল সহ দেশী-বিদেশী সকল প্রচলিত পণ্য পাওয়া যায়। গ্রাম এখন শহর। এই গ্রাম শহরে রুপান্তরের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রতিটি গ্রামে স্কুল ও সরকারের অবৈতনিক শিক্ষা এবং বিনামূল্যে প্রস্তুক দেয়ার পরিকল্পনা। এতে গ্রামে নারী শিক্ষার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের অর্থনৈতিক হাল ধরেছে নারীরা।

দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//