মোঃ খায়রুল ইসলাম, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ঃ পাহাড় চলে এসেছে ইটের ভাটায়! হাত-পা না থাকলেও টুকরো টুকরো করে ছয় এবং দশ চাকার ট্রাকে ভরে পাহাড়কে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। পাহাড়, প্রকৃতির আশির্বাদ। মাটির রং লাল। এটি প্লাইস্টোসিনকালের পাহাড়। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পূর্ব এলাকা মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের একটি অংশ। আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ।
তবুও লালমাটিতে কালো হাতের থাবা চলছে জোরেশোরে। পুরো রমজান মাস ধরে চলে নিষিদ্ধ এ যজ্ঞের উৎসব। যা এখনো চলমান। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ, হুমকিতে জীববৈচিত্র স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, লক্ষিন্দর ইউনিয়নের ফটিয়ামারি এলাকায় টানা দুই মাস ধরে চলছে পাহাড় কাটা। আর এ কাজে জরিত দুলালিয়া গ্রামের মো.দুলাল ও আব্দুল জলিল, মধুপুরচালা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, ফজর আলী ও জুব্বার আলী। আকাশ এবং সাগর নামে দুইটি ইট ভাটায় শেয়ার রয়েছে মো.দুলালের। কৌশলে মোবাইল ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথার এক পর্যায় ফটিয়ামারি পাহাড় কাটতে আর কতদিন লাগবে? এমন প্রশ্ন করা হলে; উত্তরে তিনি বলেন সপ্তাহখানেক হলেই শেষ হবে।
একই ইউনিয়নে পাহাড় কাটা হচ্ছে মুরাইদ ও সাপমারা এলাকায়। মুরাইদ এলাকায় যাদের নেতৃত্বে কাটা হচ্ছে তারা হলেন-মাস্টারবাড়ি এলাকার লেবু মিয়া ও চকপাড়া গ্রামের সাদিক মিয়া। সেখানে পাহাড় কাটা চলছে প্রায় বিশ দিন ধরে। সাপমারা এলাকায় এ কাজের সঙ্গে জরিত ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চানু মিয়া ও শিরু মিয়া, মুরাইদ গ্রামের গোলাপ হোসেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য, এদের পেশাই নাকি পাহাড় কাটা। গোলাপ হোসেন জানান, মাস খানেক সময় পেলেই মাটি কাটা শেষ করা যাবে। লক্ষিন্দর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চলতি বছর আকাশ ব্রিকস নামে একটি ইট ভাটার শেয়ার নিয়েছেন। সেই ভাটায় পাহাড় কাটার লাল মাটি এনে পাহাড় বানানো হয়েছে। অথচ তাঁর ভাষ্য, ‘তাঁর ইউনিয়নে কোনো পাহাড় কাটা নাই।’
রসুলপুর ইউনিয়নের পাহাড় কাটা হচ্ছে শালিয়াবহ ও নয়াপাড়া এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, নয়াপাড়া অংশে পাহাড় কাটেন আব্দুল কদ্দুস এবং হাজী নামে একজন। এলাকায় হাজী নামে পরিচিত। প্রকৃত নাম বাদশা মিয়া। বাড়ি শেরপুর জেলায়। হাজী জানান, মাটি যায় সিরামিক কম্পানিতে। কম্পানি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে, তাই আর কাটা হচ্ছে না।
সংগ্রামপুর ইউনিয়নের খাগরাটা এলাকার কিরণমালা বাজারের পাশে বিশাল আকৃতির দুইটি পাহাড় কাটা প্রায় শেষের পথে। স্থানীয়রা জানায় রমজানের শুরুতেই নাকি শুরু হয়েছিল এ যজ্ঞ। আর এ যজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ঘাটাইল ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য বাইচাইল গ্রামের মো. মিলন মিয়া ও শহিদুল ইসলাম টিক্কা। মিলনকে প্রশ্ন করা হলে কিরণমালা বাজারের পাশে পাহাড় কাটা কি শেষ? উত্তরে তিনি বলেন, শেষ হয় নাই কয়েকদিন পর আবার শুরু হবে।
সন্ধানপুর ইউনিয়নের মুন্সিগঞ্জ বাজারের পাশে এবং পলাশতলী গ্রামে টিলা কাটা হচ্ছে। পলাশতলী গ্রামের ওই কাজের সঙ্গে আছেন স্থানীয় মিনাল হোসেন, বাবু, মো.রফিক ও সোহেল নামে চারজন।
ইটভাটা মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যমতে উপজেলায় ভাটার সংখ্যা ৪৫ টি। আগামী মৌসুমে ইট তৈরির জন্য এ বছরই মাটি কেটে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। আর অধিকাংশ ভাটাতেই দৃশ্যমান পাহাড় কাটার লাল মাটি। একাধিক ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাল মাটির সঙ্গে মেশানো হয় বালু। সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে খৈল, টিএসপি ও ইউরিয়া সার। এরপর ভেকু যন্ত্র দিয়ে উলট-পালট করে স্তুপ করে রাখা হয়। নিচু জমি ভরাট কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে লাল মাটি।
উপজেলার পেচারআটা মোড়ে প্রায় দশফুট গভীর থেকে বিশাল আকারের একটি জায়গা ভরাট করা হয়েছে পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে। অথচ ওইস্থান থেকে ধলাপাড়া ফাঁড়ির দূরত্ব অর্ধ কিলোমিটারও হবে না।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমীর উদ্দিন বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত মামলা করা হচ্ছে। তবে রমজানের এই এক মাসে ঘাটাইলে কোনো মামলা হয়নি বলে তিনি জানান।
ঘাটাইল থানার ওসি আজহারুল ইসলাম সরকার বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে প্রশাসন পুলিশের সহায়তা চাইলে তা দেওয়া হয়। আমরা পাহাড় কাটার সঙ্গে জরিতদের ধরে মামলা দিচ্ছি। আমাদের যতটুকু যেখানে করার ততটুকু সেখানে করছি।
ইউএনও মুনিয়া চৌধুরী জানান, রমজান মাসে তারা পাহাড় কাটার বিষয়ে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাহাড় কাটা বন্ধ করা হয়েছে। কোথাও পাহাড় কাটার অভিযোগ পেলেই তাঁরা ছুটে যান সেখানে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নেওয়া হচ্ছে আইনগত ব্যবস্থা।
তাঁদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও জানান, চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইন শৃঙ্খলা সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাহাড় কাটার বিষয়ে পুলিশ সুপার ভ্রাম্যমান আদালতের অর্থ দন্ডের পাশাপাশি মাটি কাটার স্থান চিহিৃত করে এ কাজে জরিতদের সরাসরি ধরে পুলিশকে বাদী হয়ে মামলা করার জন্য বলেন। তবে এটা বন্ধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post