গৌরাঙ্গ লাল দাস, কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ) প্রতিনিধি :
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার পিঞ্জুরী গ্রামে বসেছে শীতলা মেলা। প্রায় দুইশত বছর আগে এই মেলার জন্ম হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেলা কমিটির সভাপতি মনি সেন গুপ্ত। তিনি জানায়, তার পূর্ব পুরুষ ক্ষিরোদ সেন গুপ্ত এই মেলাটি প্রথম শুরু করে ছিলেন। তারপর থেকে আর মেলাটি বন্ধ হয়নি। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার মেলাটি শুরু হয়। ৩দিন ধরে চলে এই মেলা। কোন প্রকার প্রচার প্রচারণা ছাড়াই এই মেলায় হাজার হাজার দর্শক ও পূজারীদের সমাগম ঘটে।
পিঞ্জুরী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি শীতলা মন্দির। এই মন্দির চত্ত্বরেই বসে শীতলা মেলা। মেলার এই ৩দিন অনেক পূজারী এখানে এসে পূজা করেন। এখানে পূজা দিলে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয় বলে অনেকেই জানিয়েছেন। অনেকে আবার সন্তানদের লেখাপড়া ও সুস্বাস্থ্য কামনায় এখানে পূজা দিয়ে থাকেন।
সে দিন ছিল মেলার দ্বিতীয় দিন। মেলায় প্রবেশ করতেই কানে ভেসে এলো একটি বাঁশির সুর । জটলা ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল আশি উর্ধ্ব এক বৃদ্ধ বাঁশি বাজাচ্ছেন।
এখানে বসেই কথা হয় তার সাথে। নাম মহারাজ হালদার। কোটালীপাড়া উপজেলার হরিণাহাটি গ্রামে তার বাড়ি। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই তার পিতা মারা যায়। মা অনেক কষ্ট করে মহারাজ হালদারকে বড় করেন। শিশু বয়স থেকেই মহারাজের বাঁশি বাজানো শখ। বাঁশি বাজাতে বাজাতে বয়স যখন বিশ তখন যাত্রা দলে যোগ দেন। বয়স যখন চল্লিশ তখন যাত্রা দল ছেড়ে বাড়ি চলে আসেন। এই বিশ বছর তিনি যাত্রা দলে যাত্রা শিল্পীদের সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাঁশি বাজিয়েছেন। এরপর চলে আসেন বাড়িতে।
বাড়িতে এসে তিনি বাঁশি তৈরী ও বিক্রি করা শুরু করেন। চল্লিশ বছর ধরে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মেলায় মেলায় বাঁশি বিক্রি করছেন। এখান থেকে মহারাজ হালদারের যা আয় হয় তা দিয়েই চলে তার সংসার। বৈবাহিক জীবনে মহারাজ হালদার চার সন্তানের জনক।
কুমিল্লা থেকে ঢুলু নামক বাঁশ এনে সেই বাঁশ দিয়ে বাঁশি তৈরী করেন মহারাজ হালদার। তিনি এই বাঁশ দিয়ে খিলা, আড়, বিন ও দোয়েল জাতীয় বাঁশি তৈরী করেন। এছাড়াও অবসর সময়ে কেউ তার বাড়িতে গেলে তাকে বাঁশি বাজানো শিখায়। বয়সের ভারে শরীরটি ন্যূজ¦ হয়ে যাওয়ার কারণে এখন আর তিনি আগের মতো সুর দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাঁশি বাজাতে পারেন না। গোপালগঞ্জ জেলার বাহিরে বিভিন্ন মেলায় এখন আর বাঁশি বিক্রির জন্য যেতে পারেন না বাঁশি তৈরীর এই কারিগর। তবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকেই আসেন তার বাড়িতে বাঁশি ক্রয়ের জন্য।
তার কাছে রয়েছে বিশ টাকা থেকে শুরু করে ৫শত টাকার বাঁশি। এই মূল্যোর মধ্যে বংশিবাদকরা তাদের পছন্দ মতো বাঁশি ক্রয় করেন। যান্ত্রিক অনেক বাদ্যযন্ত্র তৈরীর কারণে আগের মতো এখন আর বাঁশি বিক্রি হয় না বলে জানিয়েছেন মহারাজ হালদার। তারপরেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহারাজ হালদার তার এই পেশাটাকে ধরে রাখতে চায়।
উপজেলার গুয়াখোলা গ্রামের আনন্দ দাস বলেন, আমি প্রায় বিশ বছর ধরে পিঞ্জুরী গ্রামের এই শীতলা মেলায় আসি। এ বছরও এই মেলায় এসে আমার সন্তানের মঙ্গল কামনায় শীতলা মন্দিরে পূজা দিয়েছি। প্রতি বছরই এই মেলায় মহারাজ হালদারকে বাঁশি বিক্রি করতে দেখি।
শ্রীরামপুর গ্রামের নারায়ণ দাস বলেন, আমি শীতলা মেলায় বসে মহারাজ হালদারের কাজ থেকে আমার দুই সন্তানের জন্য একটি বিন বাঁশি ও একটি দোয়েল বাঁশি ক্রয় করেছি। এর আগেও কোটালীপাড়ার বিভিন্ন মেলায় মহারাজ হালদারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের বাঁশি ক্রয় করেছি। তার বাঁশিগুলো খুবই ভালো মানের।
পিঞ্জুরী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মনি সেন গুপ্ত বলেন, আমি ত্রিশ বছর ধরে এই শীতলা মেলা ও মন্দির কমিটির সভাপতি। এই মেলাটিতে শুধু সনাতন ধর্মালম্বীরাই আসেন না। এখানে সকল ধর্মের লোকজনই আসেন। এটি এখন একটি অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। আমি প্রতি বছরই এই মেলায় মহারাজ হালদারকে বাঁশি বিক্রি করতে দেখি।
মহারাজ হালদার বলেন, আমার কাছে অনেকেই বাঁশি বাজানো শিখেছে। কিন্তু কেউ বাঁশি তৈরী করা শিখেনি। আমি চাই আমার মৃত্যুর আগে কেউ না কেউ এই বাঁশি তৈরী শিখুক। তারা যেন এই বাঁশি তৈরীর মধ্যে দিয়ে আমার এই দীর্ঘদিনের সাধণার ফসল ধরে রাখতে পারে। মৃত্যুর পরে আমি আমার এই কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাই।
দৈনিক দেশতথ্য//এইচ//

Discussion about this post