পাওনা আদায়ে উপজেলা প্রশাসন ও পরিষদ নীরব
জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাছে এক ত্রিশ বাংলা পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছেন কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন। বিভিন্ন ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ এই বিপুল অঙ্কের পাওনা আদায়ে উপজেলা প্রশাসন কিংবা উপজেলা পরিষদ নীরব বলে জানা যায়।
তথ্য মতে, ২০১৭ সালে কর্ণফুলী উপজেলা সৃষ্টি অবধি কোন বছরের সম্পূর্ণ ঘাটের ৫০ ভাগ অর্থ পরিশোধ করেনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এমনকি কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদও আদায়ে সক্রিয় নয়।
অথচ স্বতন্ত্র কর্ণফুলী উপজেলা হওয়ার মেয়াদকাল চলছে প্রায় ৮ বছর। ২০১৯ সালে তৎকালীন ইউএনও সৈয়দ শামশুল তাবরীজ (বর্তমানে এডিএম কুমিল্লা) চসিক থেকে ২০ লাখ টাকা পাওনা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর কোন ইউএনও চসিক থেকে ঘাটের ইজারা অংশ আদায় করতে পারেনি।
এমনও হতে পারে ইউএনও ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও চসিক বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। বার বার তাগাদা দিলেও অর্থ পরিশোধে উদ্যোগ নিচ্ছে না চসিক।
দীর্ঘদিন এই অর্থ অনাদায়ের কারণে উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরীণ খরচ ও উন্নয়নের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। তবুও ইজারার সমুদয় অর্থ বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে রয়েছে। আদায়ে প্রতিকার পাচ্ছে না উপজেলা পরিষদ।
চসিক সূত্র বলছে, গত বছরে ৩০ বাংলায় সল্টগোলা ডাঙারচর ফেরিঘাটের সরকারি মূল্যের চেয়ে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৫২ লাখ ১১ হাজার টাকা, সদরঘাটের প্রাপ্ত দর ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৫ টাকা, অভয়মিত্রঘাটের প্রাপ্ত দর ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা।
২০২৪ সালে চসিক কতৃক প্রকাশিত দরপত্র বলছে, সল্টগোলা ঘাটের সম্ভাব্য মূল্য ৫৭ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা, বাংলা বাজার ঘাট ২৪ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকা, সদরঘাট ২১ লাখ ৯৭ হাজার ১২৪ টাকা,
১১ নম্বর মাতব্বর ঘাট ৮৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৩ টাকা, ১২ নম্বর তিন টিংগা ঘাট ২১ লাখ ৬০ হাজার ১২৫ টাকা, অভয়মিত্র ঘাট ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। কর্ণফুলী সংশ্লিষ্ট সব ঘাটের ৫০ শতাংশ ইজারা যোগ করলে প্রায় ৮ কোটি টাকা চসিকের কাছে কর্ণফুলীর পাওনা।
এসব ঘাটগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী উপজেলা সংলগ্ন বিভিন্ন ঘাটের অবস্থানে দেখা যায়, জুলধা ইউনিয়নের ১১ নম্বর মাতব্বরঘাট, জুলধায় ৯ নম্বর ও ৭ নম্বর ঘাট সংযুক্ত। বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর এলাকার ১২ নম্বর ঘাট, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের অভয়মিত্রঘাট ঘাট টু পুরাতন ব্রিজঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, একই ইউনিয়নের বিপরীতে রয়েছে সদরঘাট, ফিরিঙ্গাবাজার ব্রিজঘাট, সদরঘাট ও নতুন ঘাট রয়েছে। সর্বশেষ শিকলবাহা ইউনিয়নের বিপরীতে রয়েছে চাক্তাই ঘাট ও ক্ষেতচর ঘাটের অবস্থান।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
গত বছরের প্রাপ্ত তথ্যের হিসাব বলছে, চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ প্রাপ্য হন প্রায় ৭ কোটি টাকা। এর বিবরণে দেখা যায়, ১৪২৪ বাংলা ও ১৪২৫ বাংলা মতে চসিকের কাছে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা ১ কোটি ১৫ লাখ ৩ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে ২০১৯ সালে ২০ লাখ টাকা চসিক থেকে আদায় হয়। এর পরে আর কোন অর্থ আদায় করতে পারেননি।’
এতে চসিকের কাছে পাওনা বকেয়া রয়ে যায়, ৯৪ লাখ ৫২ হাজার ৮১১ টাকা। পরবর্তী ১৪২৬ বাংলায় চসিকের কাছে পাওনা ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ২৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, ১৪২৭ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬১৪ টাকা, ১৪২৮ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭৩ টাকা, ১৪২৯ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৫ টাকা। ফলে, ১৪২৯ বাংলা পর্যন্ত চসিকের কাছে বকেয়া পাওনা ৫ কোটি ২৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩০ টাকা ৫০ পয়সা। ১৪৩০ বাংলা ও ১৪৩১ বাংলা বাবদে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা প্রায়। এতে চসিকের কাছে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের মোট পাওনা প্রায় ৮ কোটি টাকা। যা পেলে কর্ণফুলী অনেক উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিতে পারতেন।
সিটি কর্পোরেশন হিসাব শাখার একাউন্ট অফিসার (এও) মোহাম্মদ হুমায়ুন বলেন, ‘চসিকের এস্টেট শাখার হিসাবে হয়তো কর্ণফুলী উপজেলার পাওনা ৮ কোটি টাকার উপরে। কিন্তু আমার কাছে ৭০ লাখ টাকার বকেয়ার হিসাব আছে। বাকিটা মেয়র মহোদয় হতে অনুমোদন হয়ে আসেনি। আসলে বলতে পারব মোট কত বকেয়া রয়েছে। তবে গত বছরে উপজেলা পরিষদ ১০ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন।’
কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চসিক পাওনা পরিশোধ করছে না বিধায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির প্রতিত্তরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অফিসের মাধ্যমে ডিডিএলজি মারফত তদন্ত হয়ে মন্ত্রণালয়ে গেছে। পরে মন্ত্রণালয় চসিককে চিঠি দিয়ে কর্ণফুলীর পাওনা টাকা পরিশোধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পরিশোধ করেনি চসিক।
কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়ন ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধিরা জানান, ‘কর্ণফুলীর পাওনা টাকা গুলো না দেওয়ায় দক্ষিণপাড়ের ঘাট গুলো সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শহর কুলের ঘাটগুলোতে উন্নয়ন কাজ হয়। কর্ণফুলীর ঘাটগুলো অবহেলিত। এতে সাধারণ মানুষের নানা অভিযোগ ও ক্ষোভ রয়েছে। চসিকের উচিত প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ করা।’
এ বিষয়ে জানেত কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীকে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি সবেমাত্র কয়েক মাস। বিষয়টির খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ বিভিন্ন ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ যে বকেয়া পাওনা রয়েছে তা রাজস্ব শাখা হিসাব নিকাশ করে চূড়ান্ত করলে পরিশোধ করা হবে।’
চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন ঘাটের ইজারা বিষয়ক ফাইলটি এস্টেট শাখায় রয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//১৮ এপ্রিল ২০২৪//

Discussion about this post