ধানের ভরা মৌসুমে কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা করে বেড়ে গেছে সব ধরনের চালের দাম। বস্তায় বেড়েছে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা করে, তাও আবার মাত্র সাতদিনে। গেল শুক্রবারের পর থেকে গত দু’দিনে বাজারে চাল কিনতে গিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছে সাধারণ মানুষ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত চাল রফতানি সীমিত করবে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পাইকাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে অসাধু মিলাররা ধান কিনে রাখছেন। বড় ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়ার আশায় টনে টনে চাল মজুত কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চালের দাম বাড়ছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত রোববার বলেছেন, ধান কিনে মজুত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো পরিণতি আনবে না। এমন পরিস্থিতিতে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অ্যাকশনে যেতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেউ অবৈধভাবে চাল মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত কয়েক মাস ধরেই দেশে সকল ধরনের ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত আকাশচুম্বী হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যেখানে নাভিশ্বাস উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে চালের দাম বাড়ায় ক্রেতাদের এখন আহি অবস্থা। গত দুই বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারির খুচরা পর্যায়ের গড় দামের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ প্রকাশিত হেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জানুয়ারিতে মুচরা বাজারে সাধারণ মানের (মোটা চাল) প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ৩২ টাকার কিছু বেশি। সেই চালের দাম এ বছর হয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। পাঁচ বছরে প্রতিনিয়ত বেড়েছে চালের দাম ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ মানের চালের প্রতি কেজিতে গড় দাম ছিল ৩৬ টাকা। সেটি বেড়ে ২০১৮ সালে ৪৭ টাকায় বেশি ছাড়িয়ে যায়। কয়েক দফা ভা-নামার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসে। এরপর আবারো বাড়তে থাকে চালের নাম। সেই বছর নভেম্বরেই
ভোক্তা পর্যায়ে প্রতিকেজি চালের গড় দাম ৪৮ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের মে ও সেপ্টেম্বরে সাধারণ মানের চালের দাম ৪৯ টাকায় উন্নাত হয়, যা চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে আসে।
বন্ধায় তিনশ’-চারশ’ টাকা বেড়েছে দাম গত ২৮ মে চালের দাম হঠাৎ করেই আরও বেড়ে যায়। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত পাইকারিতে সরু ও মোটা চালের দাম বস্তায় তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা করে বেড়েছে। পাইকারদের দাবি, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মিনিকেটের নতুন রেট ধরেছে ৬৮ টাকা, যা ছিল ৬৩ টাকা রশিদ মিনিকেটের নতুন পর ৬৪ টাকা, যা ছিল ৬০ টাকা। বিআর-২৮ চালের নতুন দাম মানভেদে ৪৮ ৫৫ টাকা, যা দু’দিন আগেও ৪৬-৪৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া নাজিরশাইল ৭৮-৮২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায়। মোটা চাল (স্বর্ণ) বেড়ে হয়েছে কেজি প্রতি ৪৬ টাকা। পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরা বাজারে সব ধরনের চাল আরও ৮-১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অভিযোগের তীর মিলার ব্যবসায়ীদের দিকে
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারে ঘন্টায় ঘন্টায় চালের দাম বাড়ানো হয়। ইউসুফ হোসেন নামে এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, ব্রি-২৮ চালের দাম ৫৫ টাকা হলেও আমাদের লাভ হচ্ছে ১ থেকে দেড় টাকা। আগে ২ টাকা লাভ হতো। এখন ক্রেতারও বউ, আমাদেরও কষ্ট। পাইকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল নেই। এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, আগে তো মিলাররা ছিল, তারা মজুত করে দাম তেমন একটা বাড়ান্ত না। যেভাবেই হোক সরবরাহ নিশ্চিত করত। এখন চালের মৌসুমেও সরবরাহ নিশ্চিত করে না মিলাররা। বর্তমানে ৫০ শতাংশেরও কম চাল সরবরাহ হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো. সুমন বলেন, এখন বড় বড় কোম্পানির (ক্রপোরেট প্রতিষ্ঠান) হাতে ব্যবসা চলে যাওয়ায় মাঝারি আকারের যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল, তা বন্ধ হয়ে গেছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এসে এমন অবস্থা করেছে, এমন পরিস্থিতি বিগত ৩৫ বছরের ইতিহাসে আমরা দেখিনি। মিরপুর-১ ঢাল আদ্ভুত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ বলেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চালের চাহিদা জানিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার চালকলে ফোন করলেই মানিকেরা বাড়তি দামের কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন।
উৎপাদন খরচের সঙ্গে ফারাক অনেক
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মালশন গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, তিনি বিআর-৪৯ জাতের ধান বিক্রি করেছেন এক হাজার টাকা মণ দরে। জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, আমরা বাজার থেকে ধান ক্রয় করার পর আড়তদারিসহ সেবার ও পরিবহন বাবন দিল পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতি মণ ধানে ২৫ থেকে ২৮ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে ধান থেকে চাল উৎপাদন ব্যয় দুই রকম একটি হাসকিং পদ্ধতিতে চাপ উৎপাদনে প্রতিমণে খরচ ৬০ টাকা। অটোমেটিক রাইস মিলে প্রতিমণ উৎপাদন খরচ ৮০ টাকা। বর্তমান ধানের বাজার দর এক হাজার ১০০ টাকা। সে হিসেবে ধান কেনা থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন পর্যন্ত মোট রায় এক হাজার ১৮৫ থেকে এক হাজার ১৯০ টাকার মতো ব্যয় হয়। তিনি জানান, প্রতিমণ ধানে ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। প্রদ্ধতিতে উৎপাদিত চাল বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ৪৪ টাকা দরে এবং অটোমেটিক রাইস মিলে উৎপাদিত ঢাল প্রতিকেজি বিক্রি করা হয় ৪২ টাকায়।
তদারকির তাগিদ সংশ্লিষ্টদের
প্রতিবছর এই সময় বাজারে চালের দাম কম থাকে। এবার চিত্র উল্টো। এমন পরিস্থিতিতে তদারকি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ অটো মেরুর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, জীবনে এই ভরা মৌসুমে এভাবে চালের দাম বাড়তে দেখিনি। দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াি ধান ও চাল মজুত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো দরকার। মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে অ্যাকশনে যেতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবে চাল মজুত করতে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হস্পকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য জানান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, চাল ও তেল নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। মার্কেট সার্ভে করে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে বলা হয়েছে। তেলের মতো চল ইস্যুতেও অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে বাণিজ্য, খাদ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জা//দেশতথ্য/৩১-০৫-২০২২//১০.৩৪ এএম
–

Discussion about this post