জাপানী বুদ্ধিজীবী তানাকা মাসাআকি ছিলেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক দার্শনিক, আধুনিক ইতিহাস সমালোচক, লেখক এবং সংবাদপত্র সম্পাদক ছিলেন। ১৯১১ সালের ১১ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৬ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ছিল তাঁর জীবন ক্রম।
১৯৭২ সালের প্রথম দিকে প্রথম দিকে হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে সরকারিভাবে একদল সাংসদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ঢাকায় আসেন বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের আমন্ত্রণ জানাতে। এই দলের অন্যতম ছিলেন তানাকা মাসাআকি। তাদের সাথে আরো ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনির বিশেষ ফোর্স “এফ-কিকান” ইন্টেলিজেন্স অপারেশন প্রধান লে.জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি। জেনারেল ফুজিওয়ারা। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে করমর্দনরত ঐতিহাসিক আলোকচিত্র তোলা হয়েছিল।১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাপানে গেলে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার সঙ্গেও ছিলেন তানাকা।
বিরলতম ব্যক্তিত্বের অধিকারী তানাকার সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। তাকে ফোন করে ১৯৯৯ সালে ডিসেম্বর মাসের এক রোববারে তাঁর বাসভবনে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ সফরের ২৪ বছর পর কোন বাঙালী তাকে ফোন করবে এটা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। বাসায় একজন বাঙালীকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দেশের লোক আমার বাড়িতে এসেছে এটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সংবাদ পেয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৭৫ এর পর বাংলাদেশ আমাদের ভুলে গেলেও আমি বাংলাদেশ ও বাঙালিকে ভুলে যায়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বললেন, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি খুবই বিচলিত হয়েছিলাম। এরপর আমাদের রাজনৈতিক সহযাত্রী একাধিক বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাসীন দল এলডিপি’র সাংসদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে টোকিওর রাজপথে নেমেছিলাম। আমরা বাঙালীর স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছি। ভারতে আশ্রিত বাঙালী শরণার্থীদের জন্য অর্থ তহবিল গঠন করেছিলাম। আমাদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী ও সাংসদ এলডিপি তথা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি।
তিনি আরো বলেছিলেন, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী রাসবিহারীকে দেখেছি টোকিওর শিনজুকু, গিনজা প্রভৃতি শহরে। গিনজা ছিল বিহারী বসুর খুব প্রিয় জায়গা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখেছি। যুদ্ধের পর টোকিওর মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের (১৯৪৬-৪৮) ১১জন বিচারপতির অন্যতম প্রধান ভারতীয় প্রতিনিধি বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া বিচারপতি রাধাবিনোদ পালকে। বিচারপতি পাল আমাকে নিজের পুত্রবৎ মনে করতেন। তাঁর গুরুজন শিমোনাকা ইয়াসাবুরোওকে পরিচয় করিয়ে দেন বিচারপতি পালের সঙ্গে।
শিমোনাকা জাপানে স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি, যিনি একাধারে মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশনা সংস্থা হেইবোনশা পাবলিশার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ, মৃৎশিল্পী এবং শান্তিবাদী প্যান-এশিয়ানিস্ট। পাল-শিমোনাকা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জাপানের আধুনিক ইতিহাসে এক কিংবদন্তিতুল্য অধ্যায়।
একই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট জাপানি বন্ধু ফুকিউরা তাদামাসা স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি এশিয়ান মুক্তি আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, জেনারেল ইওয়ানে মাতসুই এর একান্ত সচিব হিসেবে গ্রেটার এশিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকীয় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি, তাকুশোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব কনস্ট্রাকশন অ্যালায়েন্সের মহাসচিব, এবং আন্তর্জাতিক শান্তি সমিতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। এশিয়ার একাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, এঁরা সবাই মনীষী ওকাকুরা তেনশিনের ভাবশিষ্য এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত ও বাঙালির ভাতৃপ্রতিম বন্ধু। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন এশিয়ার মুক্তি এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক।
প্রায় দুঘণ্টা তাঁর বাসভবনে ছিলাম, নানা কথা হয়েছিল তার কিছু আমার “জানা অজানা জাপান” গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশের পথে “বঙ্গবন্ধু এবং জাপান সম্পর্ক” গ্রন্থেও থাকবে।
লেখক: লেখক বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি। লেখাটি সম্পাদনা করেছে দৈনিক দেশতথ্যের ঢাকা ডেস্ক।

Discussion about this post