কুষ্টিয়ায় জাল দলিলে জমি জালিয়াত চক্রের দৌড়াত্ম আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে চিহ্নিত জালিয়াত চক্রের সাথে যোগসাজসে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে এসব জালিয়াতি দলিল সম্পাদন করা হয়েছে। চলতি বছরেই এই দপ্তর থেকে এমন ছয়টি জাল দলিলের তথ্য ফাঁস হলে জেলা জুড়ে ব্যাপক চা ল্যের সৃষ্টি হয়। এসব জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, তারা এই জালিয়াতির ঘটনার পরিসমাপ্তিসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন প্রতিকার চান। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্টার সুব্রত কুমার সিংহ।
এনআইডি জালিয়াতির মাধ্যমে আমমোক্তার নামা দলিল নং ৬৫৩৫ তৈরী করে অন্যের জমি বিক্রি করে দেয় এই জালিয়াতি চক্র। চক্রটি কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিস হতে ১২২৪৬/২২ ও ১২২৪৭/২২ নং জাল দলিল সস্পাদনের মাধ্যমে কুষ্টিয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে কালিশংপুর মার্কাজ মসজিদের পাশে অবস্থিত জমি যা চৌড়হাস মৌজার আরএস খতিয়ান ২৪৯ এর দাগ নং ৮১৩৩ ও ৮১৩২/৮১৬৯ এ অবস্থিত প্রায় ৬৪ শতক অন্যের জমি বিক্রী করে দিয়েছে ওই জালিয়াত চক্রটি। জমিটির প্রকৃত বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকা হলেও দলিল গ্রহিতা দৌলতপুর উপজেলার হোসেনাবাদ মাজদিয়ার গ্রামের মোকাদ্দেস আলী এবং একই উপজেলার কামালপুরের পিয়ারপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের কণ্যা নুরুন্নাহার খাতুন দলিল দাতা জালিয়াত চক্রের অন্যতম হোতা কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকার আসাদুর রহমান বাবুকে ১ কোটি ১লক্ষ টাকার প্রদান করে দলিল করেছেন।
অপর দলিল জালিয়াতির ঘটনায় কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিস হতে কমিশন করে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নারী এবং তার বোন গুলশানের বাসিন্দা সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সেজে পেট্রোল পাম্পসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার জমি বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। এই জালিয়াত চক্রটিও চলতি বছরেই তিনটি জাল দলিল যথাক্রমে কমিশন কেস নং ১৫ তাং ১১/০৩/২০২২ দলিল নং ২৫৩৩/২০২২ দাতা জোবায়দা নাহার শেখ ও জামিলা নাহার শেখ এবং গ্রহীতা শাহ মো: মেজবাহুর রহমান ১ কোটি ৯ লাখ ৭০হাজার টাকার দলিল সম্পাদন হয়। কমিশন কেস নং ১৬, তাং ১১/০৩/২০২২ দলিল নং ২৫৩৪/২০২২ দাতা জামিলা নাহার শেখ ও জোবাইদা নাহার শেখ এবং গ্রহিতা শাহ মো: মেজবাহুর রহমান, শামসুল ইসলাম, ইউসুফ হাসাইন ও মো: সাদ্দম খা। দলিল মূল্য ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কমিশন কেস নং ১০, তাং ০৪/০২/২০২২ দলিল নং ১১৪৮/২০২২, দাতা জামিলা নাহার শেখ ও জোবায়দা নাহার শেখ এবং গ্রহিতা শামসুল ইসলাম, ৪ লাখ টাকা মূল্যের দলিল সম্পাদন করেন। একের পর এক ৬টি দলিল জালিয়াতি হয়েছে কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহের দপ্তরে। এসব ঘটনায় ডজন খানেক মামলা হলেও থেমে নেই জালিয়াত চক্রের জালিয়াতি।
জালিয়াতচক্রের দৌড়াত্মে রেকর্ডীয় সাধারণ জমি স্বত্ত্বাধিকার/মালিকরা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বলে একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীর অভিযোগ। প্রতিকার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিত ভাবে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ভুমি অফিস ও সদর সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের যোগসাজসে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেরাই দাতা গ্রহিতা সেজে একের পর এক জাল দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে অন্যের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে; কখনওবা প্রকৃত তথ্য আড়াল করে অসত্য তথ্য দিয়ে পুলিশের সাহায্য নিয়ে জবর দখল করে চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা এসব অপকর্মের সিংহভাগের যোগসাজসী দায় দিচ্ছেন কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্টারকে। সদর সাব রেজিষ্ট্রার সুব্রত রায় সিংহ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলছেন,‘জমির প্রকৃত মালিক এবং জালিয়াত চক্রের লোককে ভেরিফাই করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় চক্রটি এধরণের জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়ছে। পদ্ধতিগত ভুলের সুযোগ নিয়ে করা জালিয়াতি বন্ধ করার কোন সুযোগ নেই সাব রেজিষ্টারের হাতে’।
তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কুষ্টিয়া মডেল থানা ও পিবিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, জালিয়াতি করে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী জোবায়দা নাহার শেখ নামে এক নারী ও তার বোন সরকারী কর্মকর্তা জামিলা নাহার শেখের প্রায় ১০ কোটি টাকার ভু-সম্পত্তি কুক্ষিগত করার অভিযোগে ৯ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মডেল থানায় ৯জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এমামলার এজাহার নামীয় এক ইউনিয়ন ভুমিকর্মকর্তাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে আদালতে সৌপর্দ করা হয়েছে। আদালত গ্রেফতার ব্যক্তিদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পিবিআই কুষ্টিয়ার পুলিশ পরিদর্শক রবিউল আলম।
কুষ্টিয়া দেওয়ানী আদালতের কৌসুলী এ্যাড. আ আ সম আকতারুজ্জামান মাসুম জানান, ‘সম্প্রতি কুষ্টিয়াতে জালিয়াত চক্রের দৌড়াত্ম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কখন না জানি জালিয়াতি করে আদালত ভবনের জমি বিক্রয় করে বসে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে শহরের জিরো পয়েন্টে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসভবনের প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারী জমি নিজেদের দাবি করে দখল করে নেয়ার চেষ্টা একটা জ¦লন্ত উদাহরণ। গত ১০ মাসের মধ্যে জালিয়াত চক্রের জাল দলিলে অন্যের জমি দখলের প্রতিকার চেয়ে অন্তত ডজনখানেক মামলা হয়েছে দেং আদালতে, সেগুলি এখন বিচারাধীন। এসব জাল দলিলের সবগুলিই কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিস থেকে উৎপত্তি’।
দলিল লেখক শাহ মো: খলিলুর রহমান সনদ নং ৮০, মামলার এজাহার নামীয় ০১নং আসামী শাহ মো: মেজবাহুর রহমানের ভাই কর্তৃক সম্পাদিত এই তিনটি দলিল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি জাতিয় পরিচয় পত্র নিয়ে এসে নিজেকে ছলিমদ্দি বা কলিমদ্দি বলে দাবি করে দলিল লিখে দিতে বলেন আমরা সেটাই করে দিবো। এখানে বৈধ না অবৈধ সেটা যাচায় করার দায়িত্ব আমার না’ ওটা দেখার দায়িত্ব সাব রেজিষ্ট্রারের’।

Discussion about this post