Print Date & Time : 15 May 2025 Thursday 7:07 pm

জাল দিয়ে নুড়িপাথর সংগ্রহ করাই যাদের জীবিকা

সুদীপ্ত শাহীন, লালমনিরহাটঃ বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে নদীর পানিতে ভেসে আসা নুড়িপাথর সংগ্রহ করে বিক্রি করা অর্থে চলেছে প্রায় ১২ হাজার দিনমজুর শ্রেণির পরিবারের সংসার।

নুড়িপাথর সংগ্রহ করা তাদের পেশা। তিস্তা ও ধরলা নদীতে ভেসে আসা নুড়িপাথর দরিদ্র্য মানুষ গুলোর জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। পাটগ্রামে গড়ে ওঠেছে শতকোটি টাকার বালু, নুড়িপাথর ও পাথরের ব্যবসা। ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ নুড়িপাথর পাটগ্রাম কে গড়ে তুলেছে অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ জনপথ হিসেবে। বছরে কয়েক শত কোটি টাকার ব্যবসা।
তিস্তা ও ধরলা নদী জেলার পাটগ্রামে ভারত হতে বাংলাদেশের ভূ -খন্ডে প্রবেশ করেছে। এক সময় ধূ ধূ বিরান ভূমি ছিল পাটগ্রাম। বালু মাটিতে ফসল হত না। কষ্টে কেটেছে সাধারণ মানুষে দিন। দেশের একদম শেষ সীমান্তে ভৌগলিক অবস্থান পাটগ্রামের। এই জনপদেও মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল তিস্তা ও ধরলা নদীতে মাছ ধরা। ঐতিহাসিক পুরাতন নৌপথ তিস্তায় নৌকার মাঝিমল্লাহ হিসেবে কাজ করাটাও পেশা ছিল। এখন নদীতে আগের মত মাছ নেই। নেই কোন সওদাগরের বা ব্যবসায়ীক বাণিজ্যিক নৌকা। বেকার হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। সেই মানুষ গুলোর জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে পানিতে ভেসে আসা নুড়িপাথর। এই নুড়িপাথর ও বালুর ব্যবসা কে ঘিরে গড়ে উঠেছে পাটগ্রামে শত কোটির টাকার ব্যবসা। শেষ পর্যন্ত সেখানে বুড়িমারীতে গড়ে উঠে স্থলবন্দর। এই স্থলবন্দরটি পাথরের ব্যবসার প্রাধান্য পেয়েছে। হঠাৎ তিস্তা নদীর দিকে চোখ গেলে একটি দৃশ্য নজরকারবে। নানা বয়সের মানুষ ছোট ছোট ঝাঁকি জাল নিয়ে পানিতে ডুবছে আর ভাসছে। পানিতে ভেসে আসা মাছ যেন, ধরছে। দৃষ্টির খুব কাছে আসলে স্পষ্ট হবে। না ওরা মাছ নয়, পানির স্রোতে ভেসে আসা নুড়িপাথর ঝাঁকি জালে আটকাচ্ছে। মাছ ধরার কায়দায়। তাই মনে হয় একমনে মাছ ধরছে। এসব মানুষের কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অবচেতন মনে বিশেষ ধরনের চটকা জাল বা ঝাঁকি জাল দিয়ে নদীর পানিতে ডুব দিয়ে ডুব দিয়ে নুড়ি পাথর তুলছে। এসব নুড়িপাথর নৌকার পাটাতনে জমা করছে। পাটগ্রামের ধরলা নদীর পাড়ে শ্রমিক নুরু মিয়া (৩১) জানান, বর্ষায় নদীতে অনেক পানি থাকে। পানির কারনে স্রোতের টান থাকে। বর্ষায় তিস্তা ও ধরলা নদী হয়ে ওঠে প্রমত্ত ও পাগলাটে নদী। সেই বর্ষা মৌসুমে নদীতে নুড়ি পাথর সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যায়। তবুও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নুড়িপাথর সংগ্রহ করে। বর্ষা মৌসুমের ৩ মাস নুড়িপাথর সংগ্রহ হ্রাস পায়। ৯ মাস নদীতে পানির সাথে ভেসে আসা নুড়ি পাথর সংগ্রহ চলে পুরদমে। নদীর নুড়িপাথর সংগ্রহ করা পেশা বা জীবিকা এখানকার শ্রমজীবি মানুষের। কনকনে ঠান্ডা তবুও থেমে নেই স্রোতে ভেসে আসা নুড়িপাথর সংগ্রহ। পেটে খেলে পিটে সইতে হবে। এই সূত্রটুকু তাদের বিশ্বাসী করে তুলেছে। প্রতিদিন ভোর রাতে (সুবহসাদেক) ফজরের আজানের সুমিষ্ট শব্দে ঘুম ভাঙে এখানে। ফজরে নামাজ আদায় করে ছোট ঝাঁকি জাল সবাই হাতে হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। নদী পাড়ে গিয়ে বেধে রাখা ডিঙ্গি নৌকা পানিতে ভাসিয়ে দেয়। তারপর নদীর মাঝে নৌকাটিকে বেঁধে রেখে নিয়ে নেমে পড়ে নুড়ি পাথর সংগ্রহে। এক একটি ডিঙ্গি নৌকায় ৫/৭ জন মিলে দল বেধে পাথর সংহের কাজটি করে। দলবদ্ধ ভাবে নুড়িপাথর সংগ্রহে সুবিধা বেশী কাজটি সহজ হয়ে যায়। সারাদিনে সংগ্রহ করা নুড়িপাথর নৌকায় ভাসিয়ে এনে নদী পাড়ে ডাঙ্গায় নুড়ি পাথরের মহাজনদের গদিঘর বা খামালে বেঁচে দিয়ে নগদ অর্থ সংগ্রহ করে নেয়। এই নুড়িপাথরের পাশাপাশি সারাদেশে মোটাদানর পাটগ্রামের খসখসে বালু নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে খুব জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ। বালু ও নুড়িপাথর ঘিরে এখন এখানে বছরে কয়েক শত কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে ওঠেছে। প্রসিদ্ধ বানিজ্যিক কেন্দ্র এখন পাটগ্রাম। পাটগ্রামে বালু ও পাথরের ব্যবসাকে ঘিরে ১৯৮৮ সালে বুড়িমারী শুল্ক স্টেশন গড়ে ওঠে। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে বুড়িমারী স্থলবন্দর হিসেবে গড়ে তুলেছে। দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দও গুলির একটি বুড়িমারী স্থলবন্দর। মূলত ভারত, ভুটান ও নেপাল হতে পাথর আদমানি বেশী হয় এই বন্দর দিয়ে। দুইটি নদীর উৎস ভারতের উজানে হিমালয়ের পাদদেশে। শীত মৌসুমে নদীর ভেসে আসা নুড়িপাথর এক ঘন্টা বিরতি দিয়ে দিয়ে তুলে। ঠান্ডা হতে রক্ষা পেতে এটা করে থাকে। পানির উপরে উঠে রোদে শরীর গরম করে পুনরায় পাথর সংগ্রহে নেমে পড়ে। সারা দিনে একজন শ্রমিক ৪/৫ সিএফটি নুড়ি পাথর সংগ্রহ করে। তাতে দৈনিক ৪/৫ শত টাকা আয় হয়। নুড়ি পাথর বিক্রির অর্থে সন্ধ্যায় বাজারে চাল, ডাল, তেল ও নিত্য প্রয়োজনীয় সদাইপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরে নুড়িপাথর শ্রমিকরা। বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনরা পথ চেয়ে থাকে। বাজার গেলে রান্না হয়। সকলে মিলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোওে উঠে কাজে যায় এটাই তাদের স্বাভাবিক জীবন। পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রুহুল আমীন বাবুল জানান, নুড়িপাথর, বালু ও আমদানিকৃত বোল্ডার পাথরের বৗবসা ঘিরে সমৃদ্ধ জনপদ পাটগ্রাম। শুরুটা নুড়ি পাথর দিয়ে হয়েছ। দেশে বড়বড় স্থাপনা বা নির্মাণ কাজ শুরু হলে ভাগ্য খুলে যায় নুড়িপাথর সংগ্রহের শ্রমিকদের। নুড়িপাথর, বালু ও পাথরের কয়েক শত কোটি টাকার ব্যবসা এখানে প্রতিবছর হয়। এই পাথর কেনা বেচা সকল ধরনের ব্যবসা বাণিজ্যে গতি এনে দিয়েছে। পাথরের ব্যবসাকে ঘিরে চাঙ্গা সকল মানুষ। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এখানে বেকার সমস্যা নেই বললে চলে। পাটগ্রামের পাথর, নুড়িপাথর ও দানাদার বালু দিয়ে বাংলাদেশের গর্ব পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। পূর্বপুরুষদের অনুসরণে পাথর শ্রমিকরা নদী থেকে পাথর তুলে সংসারের ভরণপোষণ করছেন। ব্যবসায়ীরা পাথরের সিএফটি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনে নেয়। তারা সেগুলোকে বেশি দরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করে। নুড়িপাথর ব্যবসায়ী মহাজন রফিক মিয়া (৪৫) জানান, মহাজনের কাছে সিএফটি হিসেবে বিক্রি করে নগদ অর্থ উপার্জন করে বাড়ি চলে যায় শ্রমিক। মহাজনরা অল্প অল্প নুড়িপাথর কিনে জমা রাখে। এক ট্রাক জমা হলে তবে বিক্রি করে। এক ট্রাক জমা করতে সপ্তাহ লেগে যায়। পাহারাদার, জমির ভাড়া নদীর পাড় হতে খামালে বা গদিতে আনা সহ নানা ধরনের খরচ আছে। নানা সময় আর্থিক সহায়তার জন্য আসে মানুষ এখানে আসে। তাদের সন্তুষ্ট করতে হয়। নুড়িপাথর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রাকভর্তি করে পাঠাই। ট্রাক দূর্ঘটনায় পড়ে, বিশ্বাস করে ব্যবসা বাকি দিতে হয়। পাথরের বকেয়া টাকা কেউ না দিলে ক্ষতি মুখে মহাজনকে পড়তে হয়। পাথরের ব্যবসা করতে গিয়ে পথে বসে যাওয়ারও নজির এখানে আছে ।
খনিজ সম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের খনিজ সম্পদের তালিকায় আছে নুড়ি পাথর। দেশে ছয়টি এলাকায় নুড়ি পাথর পাওয়া যায়। এরমধ্যে সিলেটে প্রায় ৮০০ টন, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় ৫০০, সুনামগঞ্জে ৬০০, ডিমলায় ১০০, পঞ্চগড়ে ১০০, পাটগ্রামে ১০০ মিলিয়ন টন নুড়ি পাথর মজুত আছে বলে জিএসবি জানায়। পাটগ্রামে শুধু নদীর জলে ভেসে আসা নুড়িপাথর আছে এমন নয়। সেখানে ভূ গর্ভস্থ বালু ও নুড়ি পাথর প্রচুর পরিমাণে মজুদ আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে মাটির উপরিভাগের দুই/ ফিট খুড়লে মোটা দানাদার বালু ও নুড়ি পাথর পাওয়া যায়। যদিও ভূ গর্ভস্থ বালু, নুড়ি পাথর ও পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। দেশের প্রচলিত আইনানুসারে সকল ধরণের খনিজ সম্পদের মালিক রাষ্ট্র। পাটগ্রামে বেশকিছু স্থানে নুড়ি মিশ্রিত বালিও পাওয়া যায়। । খনিজ বালির ক্ষেত্রে ফিজিবিলিটি স্টাডি করে পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কিনা তা যাচাই করা হয়নি। অন্যদিকে, ভূ গর্ভস্থ বালু, নুড়ি পাথর, পাথর ও ধাতব মিশ্রিত বালি তুলতে গেলে ফসলের জমি নষ্ট হয়ে যায়। পরিবেশের কথাটিও চিন্তা করতে হচ্ছে।