জে.জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃচট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ (সিডিএ) এর অধিগ্রহণকৃত ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমিতে কয়লা ও পাথরের ব্যবসা করে আসছেন কর্ণফুলীর যুবলীগ নেতা আনোয়ার সাদত মোবারক। কিন্তু এ জমি নিয়ে চলছে সিডিএ এবং দখলদারের মধ্যে আইনি লড়াই। রয়েছে আদালতের স্থিতাবস্থাও। ভূমির মালিকানা দাবি করে যুবলীগ নেতাও আদালতে লড়ছেন। আইনের গ্যাড়াকলে পড়ে থেমে যায় সিডিএ’র উচ্ছেদ অভিযানও। ফলে, জমিটি গত ২০ বছর ধরে প্রভাবশালী এই যুবলীগ নেতার দখলে রয়েছে।
জানা যায়, কর্ণফুলীর পুরাতন ব্রিজঘাট এলাকার কয়লার মাঠটি সিডিএ মাঠ হিসেবেও পরিচিত। মাঠটির পাশেই চসিকের যাত্রী ছাউনি ও ঘাট। গত ৩ জানুয়ারি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত অভিযান চালিয়ে মাঠটি দখলমুক্ত করেন। ওই সময় মাঠে থাকা সাহারা এন্টারপ্রাইজ কোন কাগজপত্র দেখাতে না পারায় ডিপো ইনচার্জ মো. আল আমিনকে ১ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেন। পাশাপাশি মজুদ করা কয়লা ৭ দিনের মধ্যে নদী তীর থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে কর্ণফুলী উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘গত ০৩ মার্চ নদী তীরের সাম্পান খেলায় ডিসি স্যার অতিথি হয়ে আসলে নির্দেশ দিয়ে যান, উচ্ছেদ হওয়া কয়লার মাঠে প্রকল্প দিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করতে। যা নিয়ে ইউএনও স্যার কাজ করছেন।’ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কর্ণফুলী ইউএনও মো. মামুনুর রশীদও।
যদিও বর্তমান দখলদার দাবি করেছেন, ‘১৯৬৬-৬৭ সালে জমিটি তাঁর পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে সরকার অধিগ্রহণ করেছিলেন ভাসমান ব্রিজের জন্য। কিন্তু বর্তমানে কোন ভাসমান ব্রিজের অস্তিত্ব নেই। জমিটিও পরিত্যক্ত পড়ে আছে। অধিগ্রহণের শর্ত মোতাবেক ওই জমি সরকারের কাজে ব্যবহৃত না হলে মূল মালিক ব্যবহার করতে পারেন। এ কারণে মাঠটি তারা দখলে রেখেছেন।’
এমনকি সিডিএ মাঠে একটা কালো সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন। তাতে লিখা আছে ‘তপশীলোক্ত সম্পত্তি বিষয়ে সৈয়দ আহমদ গং এর পক্ষে আনোয়ার সাদত মোবারক বাদি হয়ে সিডিএ কে বিবাদি করে তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত চট্টগ্রামের দায়েরকৃত অপর মামলা-২৪৩/০৩ সালে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্তে বিজ্ঞ আদালত গত ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে ৭১ নং আদেশের সংক্ষুব্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে সিভিল রিভিশন নং-৪৪১৪/১৬ ইং মামলায় তপশীলের সম্পত্তিতে স্থিতবস্থায় আদেশ প্রদান করেন এবং রুল জারি করেন। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।’
এ বিষয়ে বাদি যুবলীগ নেতা আনোয়ার সাদত মোবারক বলেন, ‘ওই জমি নিয়ে আমরা মহামান্য হাইকোর্টে মামলা করেছি। এখানে হাত দেওয়া যাবে না। নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আগামী ২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আমি সব কাগজ ইউএনও স্যারকে দিয়ে এসেছি। পাশাপাশি বিষয়টি যেখানে যেখানে জানানো দরকার আমি জানিয়েছি।’
জমিটির বিষয়ে তথ্য মিলে, চরপাথরঘাটা মৌজার ৩ নং খতিয়ানে সিডিএ এর ১৫ দশমিক ৩৮ একর জমি রয়েছে। ওই খতিয়ানের বিএস ২৫ দাগটি হলো কয়লার মাঠ। যেখানে মোট ৩ একর জমি আছে। খতিয়ানে দখল বিষয়ক মন্তব্যে একটি দালানেরও অস্তিত্ব মিলে। বর্তমান জমিটির বাজার মূল্য ৪৫ কোটি টাকার সম্পত্তি প্রায়। একই খতিয়ানে ৬৮ দাগটি পুকুর। এ দাগে জমি আছে ১ একর ৫৭ শতক। যেখানে বর্তমানে ছেলেরা খেলাধুলা করেন।
বিশেষ সূত্রে আরও তথ্য মিলে, ২০০৬ সালে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ঢাকা ০৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে খালেদা জিয়ার মন্ত্রী সভায় যোগ দেন। ওই সময় তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে উনার এক আত্বীয়ের (বেয়াই সম্ভবত) মেসার্স সাবরিনা এন্টারপ্রাইজের নামে বর্তমান কয়লার মাঠ ও তৎকালিন পুকুরের জমিটি ইজারা নিয়েছিলেন। যেহেতু সিডিএ এখনো গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে। পরে যা মামলার মারপ্যাঁচে পড়ে।
এদিকে, বর্তমান দখলদার মামলার বিষয়ে জানালেও তথ্য উপাত্ত অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৬ বছরে সিভিল রিভিশন ৪৪১৭/১৬ মামলাটি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক মো. এমদাদুল হক আজাদ কোর্ট নং-১১ (এনেক্স বিল্ডিং), কোর্ট নং-১৩ (মেইন বিল্ডিং) বিচারক মাহমুদুল হক, কোর্ট নং-০৮ (মেইন বিল্ডিং) এর বিচারক এ কে এম শাহিদুল হক ও সর্বশেষ এনেক্স বিল্ডিং ৭নং কোর্টের বিচারক মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ সকলেই মোট ৬ বার শুনানি করেছেন। এতে বাদিপক্ষ প্রথমে ১ বছরের স্থিতবস্থার আদেশ পান। পরে আরও ১ বছর, এরপর আরও ৬ মাস ও সর্বশেষ গত বছরের ১৯ জানুয়ারি আদেশ পান ‘পূর্ব প্রদত্ত স্থিতাবস্থার আদেশটি মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ থেকে বিধি অনুসারে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হোক।’
এসব তথ্য জানিয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী ইউএনও মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন মাঠটিতে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জমিটি উচ্ছেদ মুক্ত করেছেন। সেখানে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শক্রমে কিছু প্রকল্প করা হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আর যদি আদালতের কোন বিষয় থাকে বিধিসম্মত ভাবে প্রশাসন তা দেখবে। দখলদার এখনো সব কাগজ সরবরাহ করতে পারেনি। কিছু কাগজপত্র দিয়েছেন। যা আমরা যাচাই বাছাই করছি।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ১৯১ টি ইউনিয়ন রয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে ১৯১টি খেলার মাঠ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।’
সিডিএ এস্টেট অফিসার (ল্যান্ড) মোঃ সাদেকুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার বিভাগ দেখেন না। এটি দেখার দায়িত্ব সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী নির্মাণের।’ পরে সিডিএ নির্মাণ বিভাগ-১ এর প্রকৌশলী কাজী কাদের নেওয়াজ এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও ফোন রিসিভ না করায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এর (এস্টেট) শাখার ডেপুটি ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নদী তীরে অবৈধ জেটি করে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। আমি কালকেই লোক পাঠিয়ে খবর নিবো। আর নদী পাড়ে আমাদের জায়গা নেই। তবে কেউ অবৈধ কাঠের জেটি তৈরি করতে পারে না। তবে সিডিএ’র জায়গায় কেউ ব্যবসা করলে সিডিএ বিষয়টি দেখবেন ।’
প্রসঙ্গত, দখলদার আনোয়ার সাদত মোবারক আগে নিজেকে সংগঠক বা উপজেলা যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিলেও বর্তমানে তিনি চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি’র দায়িত্ব পেয়েছেন।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post