দেশের ৪৯৫ টি উপজেলার মধ্যে ১৪৯টিতে রয়েছেন নারী নির্বাহী অফিসার। গাণিতিক হিসাবে যার সংখ্যা হবে ৩০.১০ শতাংশ।
নারীর ক্ষমতায়নে এই সংখ্যা সমান না হলেও একেবারে কম নয়। তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনে নারী কর্মকর্তার আধিক্য আশার সঞ্চার করে বৈকি। এই নারীরা যখন জ্যেষ্ঠতার ধাপ পেরিয়ে সচিব পর্যায়ে যাবেন তখন নারীরা পিছিয়ে আছে একথার বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী।
তবে এই সব নারীদের সফলতার উপর নির্ভর করবে উত্তরসূরীদের অগ্রসরতা। এই কাজে যারা পাইয়োনিয়ার তাদের সংগ্রাম তো এখন দৃশ্যমান। প্রশাসনে তাদের আগমন এক শ্রেণির পুরুষদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যেই এসব নারী কর্মকর্তাদের প্রতি কিছু জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, পুরুষ সহকর্মী ও ক্ষেত্র বিশেষে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের (যারা জনপ্রতিনিধি নন) চরম অসহযোগিতা মূলক আচরণ সরকারের শুভ উদ্যোগকে প্রশ্নবোধক করে তুলেছে। বিরোধীতাকারীরা লিঙ্গ বৈষম্য টেনে এনে নারী কর্মকর্তাদের একপ্রকার অপমান করছে।
তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত ১৪৯ জন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ২০২০ সালের জুন মাস থেকে চলতি বছর ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত জরিপ চালিয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ জন নারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেছেন, তৃণমূলে কাজ করতে যারা অন্যায্য সুবিধা নিতে সবচেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করে থাকেন তাদের মধ্যে আছেন সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ক্ষেত্র বিশেষে পৌর মেয়র, স্থানীয় সাংবাদিক, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা। কখনো জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং আরো কিছু ক্ষমতাধর ব্যাক্তি চাপ প্রয়োগ করে থাকেন।
বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বদ্ধপরিকর। সেকারনেই দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের একটা বার্তা ছিল যে, মাঠ পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা পদায়ন করলে তাঁরা স্থানীয়, বিশেষ করে নারীদের সমস্যাটি ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। তাঁদের সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ করতে পারবেন, অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় সমস্যার মূলে যেতে পারবেন, তাতে সমস্যা সমাধানের পথ ত্বরান্বিত হবে।
গ্রামের নারীরা এখনো অতটা প্রগতিশীল নয়। সকলের সামনে নিজেকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পারেন না। গ্রামের নারীদের এখনো এমন কিছু সমস্যা আছে যা পুরুষের সামনে ব্যক্ত করতে লজ্জা ও কুন্ঠাবোধ করেন। কিন্তু নারীর সামনে বলতে দ্বিধা, ভয় কিংবা লজ্জাবোধ করেন না।
সরকারের এমন মহৎ উদ্যোগ সাফল্যমন্ডিত করতে নারী কর্মকর্তারা যদি পদে পদে হেনস্তা হন, বাঁধার সম্মুখিন হন কিংবা প্রভাবশালীদের চাপে থাকেন, তবে তাঁদের উপর সরকারের দেওয়া দায়িত্ব কিভাবে পালন করবেন তারা?
টিআইবির জরিপ মতে নারী কর্মকর্তাদের উপর যে সমস্ত বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তন্মধ্যে আছে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, যাচাই ছাড়া ব্যয় বরাদ্দ এবং ভুয়া ব্যয়ের বিল দিতে বাধ্য করা। এ সমস্ত বিল প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বে উল্লেখিত শ্রেণির মধ্যে অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে একে অপরের সহযোগি হিসেবে নারী কর্মকর্তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। যার কারনেই অনেক জায়গায় অপ্রীতিকর সংঘর্ষের খবর মেলে। যা বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দেখা দিচ্ছে।
যে দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা নারী, রাজপথের বিরোধী দলীয় নেতা নারী, সে দেশে শুধু স্থানীয় নয়, মহান জাতীয় সংসদের কতিপয় মাননীয় সংসদ সদস্যদের মাঝেও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। কারন, কয়েক মাস আগে জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে যে ‘গার্ড অব অনার’ দেয়া হয়, তাতে ‘নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদে’র ‘বিকল্প কর্মকর্তা’ দেওয়ার সুপারিশ করা করেছে।
সকল জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তাকে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করে সংবেদনশীল আচরণ করার জন্য কী কী করা উচিৎ সে মর্মে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আট দফা প্রস্তাব দিয়েছে।
আমার মতে সরকারি কর্মকর্তাদের নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের প্রশিক্ষণ ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) জেন্ডার সংবেদনশীল সহায়ক কর্মসূচির আওতায় এনে না হয় নারী কর্মকর্তাদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ কমানো যাবে, কিন্তু বাদ বাকিদের কিভাবে নিবৃত করে মাঠ পর্যায়ের নারী কর্মকর্তাদের কাজের অনুকুল ও নির্ভার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় এ ব্যাপারে সদাশয় সরকারের নীতি নির্ধারনী মহল দৃষ্টি দেবেন আশা করি।
( লেখক পরিচিতি ঃ অধ্যক্ষ, মীর আব্দুল করিম কলেজ, মিরপুর, কুষ্টিয়া। )
এবি/দৈনিক দেশতথ্য/১০ নভেম্বর/২০২১