সুন্দরবনের দুবলার চরে আজ রবিবার থেকে ১৩৯ তম রাস উৎসব শুরু হয়েছে রাসমেলা। এই মেলা আগামী ৮ নভেম্বর শেষ হবে। কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত এ মেলায় প্রতিবছর হাজার হাজার পুণ্যার্থী ও পর্যটক আসে। রাসমেলা মণিপুরীদের প্রধান উৎসব। বাঙালী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ উৎসব পালন করে থাকে।
এ উৎসব সুন্দবনের দুবলার চর, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সাড়ম্বরে পালিত হয়। ঐতিহ্যবাহী এই রাস মেলাকে ঘিরে সুন্দরবনের চরাঞ্চল ইতোমধ্যে পূর্ণ্যার্থী ও পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার জানান, এ বছর দুবলার চরের এ মেলায় দর্শনার্থী ও পুণ্যস্নানে নিরাপদে যাতায়াতে তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ পাঁচটি পথ নির্ধারণ করেছে।
এসব পথে বন বিভাগ, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের টহল দল তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে।
তিনি আরও জানান, মেলায় যাওযার নৌযানগুলো কেবল দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবে। বন বিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না। প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রঙ দিয়ে বিএলসি অথবা সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন টোকেন ও টিকিট সবসময় কাছে রাখতে হবে। রাসপূর্ণিমা পুণ্যস্নানের সময় কোনও বিস্ফোরকদ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারও কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, হরিণ মারার ফাঁদ, দড়ি, গাছ কাটার কুড়াল, করাত ইত্যাদি পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বন আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া ট্রলারে কোনও প্লাস্টিকের খাবারের প্লেট বহন করা যাবে না। লঞ্চ, ট্রলার, নৌকায় এবং পুণ্যস্নান স্থানে মাইক বাজানো, পটকা, বাজি ফোটানোসহ কোন প্রকার শব্দ দূষণ করা যাবে না। রাস পূর্ণিমায় আসা পুণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের
কাছ থেকে প্রাপ্ত নাগরিকত্বের সনদপত্রের মূলকপি সঙ্গে রাখতে হবে।
প্রাচীন এ উৎসব সুন্দরবনের দুবলারচরে অনুষ্ঠিত হয়। রাস উৎসব নিয়ে নানা মত রয়েছে। ধারণা করা হয়, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরিভজন নামে এক হিন্দু সাধু প্রথমে এ উৎসব শুরু করেছিলেন। তিনি ২৪ বছরেরও বেশি সময় সুন্দরবনের গাছের ফল-মূল খেয়ে জীবন-যাপন করতেন। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্নাদৃষ্টি হয়ে পূজা-পর্বনাদি ও অনুষ্ঠান শুরু করেন দুবলার চরে। আর তারপর থেকেই রাস মেলা বসেছে। তবে লোকালয়ে এ মেলা নীল কোমল মেলা নামেও বেশ পরিচিত।
অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রী-কৃষ্ণ কোন এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সেই থেকেই রাস উৎসবের সূচনা ঘটে। অনেকের মতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমা রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সাথে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই এ উৎসবের সূচনা।
সুন্দরবনের দুবলাচরে ও আলোর কোলে রাস পুর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের পুজা, পুর্ণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষ্যে চলতি বছর রাস উৎসবে পুর্ণিমা তিথিতে চরে নির্মিত মন্দিরে নামযজ্ঞ, রাধাকৃষ্ণ, কমল কামিনি ও বনবিবির পূজা অনুষ্ঠিত হবে। অটুট বিশ্বাস আর পুর্ণ ভক্তিতে কমল কামিনীর দর্শন মেলে।
এ পূর্ণ বিশ্বাসে পুণ্যার্থীরা কমল কামিনীর দর্শনের আশায় নিলকোমলের (পুর্ণিমায় প্রথম আসা সমুদ্র ঢেউ) সাগর মোহনার ঢেউয়ে স্নান করে। আর প্রথম ঢেউয়ে পুণ্যার্থীরা হাতে ধরে রাখা প্রসাদ সাগর ঢেউয়ে উৎসর্গ করে, এর পর স্নান শেষে চলে আসে।
তারা পুর্ণিমার প্রথম প্রহরে সাগর জলে স্নান করে মনোবাসনা পুর্ণ ও পাপমোচনের বিশ্বাসে রাসমেলায় যোগদিলেও কালক্রমে তা বহু ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব ঘিরে সুন্দরবনের দুবলারচরে অসংখ্য বিদেশী পর্যটকদের আগমন ঘটে।
আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, নির্বিশেষে সাগর চর এলাকায় উপস্থিতিতে কোলাহল, পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে। প্রতি বছর রাস উৎসব মানুষের মিলন মেলায় রূপ নেয়। ফলে সাগরপাড়ে দুবলারচর ও আলোরকোল চর সমুহে অনুষ্ঠিত রাস উৎসব সুন্দরবনের ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
এব্যাপারে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডঃ আবু নাসের মোহসীন হোসেন বলেন, রাসমেলাকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহলে নিয়োজিত থাকবে। রাসপূর্ণিমায় পূজা ও পূর্ণস্নানে আগত তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে পশ্চিম বন বিভাগের অভিযান পরিচালনার জন্য কয়েকটি টিম কাজ করবে। সর্বশেষ তীর্থযাত্রীদের নিরাপদে চলাচলে সকল প্রকার সহযোগিতা দেওয়া হবে বলেও এ বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
//জা// দৈনিক দেশতথ্য// ০৬, নভেম্বর ২০২২//

Discussion about this post