শেখ দীন মাহমুদ,খুলনা প্রতিনিধি: নানা সংকটের মুখে ডুবতে থাকা থাকা সম্ভাবনাময় চিংড়ী শিল্পকে আন্তর্জাতিক
বাজারে টিকিয়ে রাখতে বাগদার বিকল্প হিসেবে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের অনুমতি দিয়েছে সরকার।
গত ২৯ মার্চ মৎস্য বিভাগের মহাপরিচালককে চিঠি দিযেছে সরকারের মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয়। একই সাথে ভেনামির বাণিজ্যিক চাষ নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক শুরু হয় ভেনামি চিংড়ীর পাইলট প্রকল্প। সেখানে সফলতার পর দীর্ঘ দিন থেকে চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এর বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে দাবি করা হচ্ছিল। সর্বশেষ অনুমতি প্রাপ্তিতে তাদের পক্ষে সন্তোষ প্রকাশ করে
সরকারকে সাধুবাদ জানালেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাধারণ চিংড়ী চাষীরা।
এশিয়ার ১৫ টি দেশসহ এখন বিশ্বের ৬২টি দেশে ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। নানামুখি সংকট ও বাগদার তুলনায় দাম কম হওয়ায় বিশ্বে চিংড়ি
বাণিজ্যের ৭৭ শতাংশ দখল করে থাকলেও এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এতদিন ভেনামির বাণিজ্যিক উৎপাদন নিষিদ্ধ ছিল। এর আগে বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অধীনে খুলনার পাইকগাছায় পরীক্ষামূলক পাইলট প্রকল্পে প্রতিবারই ভেনামি চাষে সফলতা আসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ভেনামির জাতটি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের। পাশ্চাত্য ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ ভারতে ২০০৮ সাল থেকে ভেনামির বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। এছাড়া এশিয়ার অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ থাইল্যান্ড ও চীনে ভেনামি
চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় আরো দু’দশক আগে ১৯৮৮ সাল থেকে। আর ফিলিপাইনে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। এছাড়া ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে শুরু হয় ২০০০ সালে।জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং গ্লোাবাল অ্যাকুয়াকালচার
অ্যালায়েন্স-এর তথ্য মতে, বিশ্বে ২০১৮ সালে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৩৫
দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন, পক্ষান্তরে বাগদার উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ৫ লাখ
মেট্রিক টন ও গলদা ২ দশমিক ৪ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য জাতের চিংড়ী উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে এশিয়ার চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও
মালয়েশিয়াতে ২০১৮ সালে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হয় ২৩ দশমিক ৯১ লাখ মেট্রিক
টন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালে দেশগুলোতে উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৩১
দশমিক ১২ লাখ মেট্রিক টন। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান শূন্য।
তবে আশার কথা পাইলট প্রকল্পে ২য় বারের মত পাইকগাছার লোনা পানি গবেষণা
কেন্দ্রের চারটি পুকুরে ভেনামির পোনা অবমুক্তি থেকে শুরু করে নমুনয়ন,
পরিদর্শন ও নিয়মিত পরিচর্যায় আশাতীত সফলতা আসে বলে দাবি করেন জেলা মৎস্য
অধিদপ্তর।
তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, বিশ্ব বাজারে বর্তমানে চিংড়ির মোট চাহিদার প্রায়
৭২ শতাংশ ভেনামির দখলে। বাকি ২৮ শতাংশ নিয়ে অন্যান্য দেশগুলোর সাথে
আমাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করতে হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভেনামির বাণিজ্যিক চাষের বিকল্প নেই। এমন
পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের দাবির মুখে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর ২০১৯ সালে
থাইল্যান্ড থেকে ভেনামির পোনা আমদানিপূর্বক খুলনাঞ্চলের এমইউসি ফুডস,
ফাহিম সি ফুডস, গ্রোটেক অ্যাকোয়াকালচার লিমিটেড, রেডিয়েন্ট শ্রিম্প
কালচার, আইয়ান শ্রিম্প কালচার, ইএফজি অ্যাকোয়া ফার্মিং, জেবিএস ফুড
প্রডাক্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও প্রান্তি অ্যাকোয়া কালচার
লিমিটেড মোট আটটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়। এছাড়া
অপেক্ষমান তালিকায় ছিল সাতক্ষীরা, খুলনা ও কক্সবাজারের একাধিক প্রতিষ্ঠান।
সূত্র জানায়, ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সাথে আলোচনার পর গত ২০১৯’র সেপ্টেম্বরে উচ্চ ফলনশীল ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়া হয় কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস
এবং সাতক্ষীরার এনজিও সুশীলনকে। এতে কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস ব্যর্থ হলেও সুশীলন প্রকল্প বাস্তবায়নে যশোরের এম ইউ সি ফুডসকে সাথে নেয়। ওই বছরের ৩১ মার্চ তারা থাইল্যান্ড থেকে বিমানযোগে ভেনামি চিংড়ির আট লাখ
রেনু আমদানি করে খুলনার পাইকগাছাস্থ বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্যগবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ লোনা পানি কেন্দ্রের চারটি পুকুরে অবমুক্ত
করে এর পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর সফলতা পেয়ে ২০-২১ অর্থ
বছরের ১০ মে রাতে তারা একই পদ্ধতিতে আরো ১২ লাখ পোনা আমদানি করে
পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি অব্যাহত রাখে।
পাইলইট প্রকল্প নিয়মিত পর্যবেক্ষনে দাবি করা হয়, ভেনামির রোগ প্রতিরোধ ও
জীবন ধারণ ক্ষমতা বাগদার তুলনায় বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পোনা ছাড়ার পর
থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত চিংড়িতে রোগবালাই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি
থাকে। বিপজ্জনক এসময়ে পুকুরের পরিবেশ, ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগবালাই
প্রতিরোধব্যবস্থা পরিদর্শন এবং এর ফিজিক্যাল গ্রোথ পরিমাপে নমুনা পরীক্ষা
করেন একটি বিষেশজ্ঞ টিম।
তাদের মতে, ভেনামির পোনা ছাড়ার পরের ৬৮ দিনে গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই
আশাব্যঞ্জক। প্রতিটির ওজন ৮ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে
থাকে। গড় ওজন পাওয়া যায়, ৮.৭৫ গ্রাম। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনকাল ১২০ দিন।
প্রথম ৬০ দিনে এদের যে গ্রোথ হয়, পরবর্তী ৬০ দিনে তার তিন গুণেরও বেশি
হয়। সে হিসেবে আশা করা যায় চিংড়ি ধরবার সময় প্রতিটির গড় ওজন পাওয়া যাবে
প্রায় ২৫ গ্রাম।
ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, কাঁচামাল হিসেবে
চিংড়ির অভাবে মাছ বন্ধের মুখে থাকা কোম্পানিগুলোতে তাদের সক্ষমতা ও ধারণ
ক্ষমতার বিপরীতে প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ অনেক বেশি। আশার কথা, হেক্টর প্রতি
বাগদার উৎপাদন যেখানে ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি সেখানে ভেনামির উৎপাদন সাত থেকে
আট হাজার কেজি পর্যন্ত সম্ভব। এছাড়া বাগদা কয়েকবার চাষ হলেও গলদার চাষ হয়
বছরে একবার। কিন্তু ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post