Print Date & Time : 10 May 2025 Saturday 11:34 am

দেয়াল ধ্বসে শিশু নিহত, তদন্ত কমিটি গঠন

চা বিক্রেতা মিঠু। গতকাল (১৩ মে) সকাল ১১ টার দিকে দোকানে বসেই খবর পান

তার একমাত্র ছেলে দেয়াল চাপায় আহত হয়েছে। এরপর তাকে নিয়ে এক হাসপাতাল

থেকে অন্য হাসপাতাল। পরে বিকেল সাড়ে ৩ টার দিকে খুলনার একটি হাসপাতালে

নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় শিশু সন্তান তামিমের।

সন্তান হারানোর শোকে বাকরুদ্ধ তামিমের বাবা মিঠু। কথা বলছেন না তিনি।

প্রতিবেদনকালে এলাকার ছোট ছেলেদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা

যায় তাকে। হয়তো ওই বাচ্চাদের ভিড়ে সন্তানকে খুঁজছেন। মাঝে মধ্যে

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলে তামিমকে ডাকছেন বাবা মিঠু। অপরদিকে মায়ের আহাজারিতে

চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। তার কান্নায় মোহাম্মদ গলির কেউ চোখে

পানি ধরে রাখতে পারেনি।

এর আগে শুক্রবার (১৩ মে) সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে খুলনা ওয়েস্টজোন পাওয়ার

ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর (ওজোপাডিকো) দেয়াল ধসে তিন শিশু মারাত্মক আহত

হয়। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তামিম নামের এক শিশু মারা যায়।

স্থানীয়রা জানায়, করিমনগর সুর মোহাম্মাদ গলির শেখ শওকাত হোসেনের ভাড়াটিয়া

মিঠু। দু’মেয়ে ও এক সন্তান নিয়ে মিঠুর পরিবার। পাঁচ বছরের অধিক সময়

সেখানে তাদের বসবাস। তিন সন্তানের মধ্যে তামিম সবার ছোট। সে করিমনগর

ফোরকানিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল।

শুক্রবার মাদ্রাসা ছুটির দিন হওয়ায় সকাল ১০ টার দিকে সাইকেল নিয়ে

সহপাঠিদের সাথে খেলার জন্য ঘর থেকে বের হয় তামিম। সাইকেল চালিয়ে তারা

তিনজন একত্রে খেলছিল। সকলে বেশ হাসিখুশি ছিল। এর মধ্যে বিকট শব্দে দেয়াল

ধসে পড়ে তাদের গায়ের ওপর। শব্দ পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে তিনজনকে উদ্ধার

করে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তামিমের

পরিস্থিতি খারাপ বুঝে সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য সোনাডাঙ্গাস্থ হেলথ

ক্লিনিকে নেওয়ার পথেই তামিমের মৃত্যু হয়।

তামিমের বাবা মিঠু জানান, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (চায়ের দোকান) খুলনা

আর্ট কলেজের পাশে। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর খবর আসে তামিমসহ আরও দু’জন

দেয়াল চাপায় আহত হয়েছে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন খুলনা মেডিকেল কলেজ

হাসপাতালে। সেখানে ছেলের অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তখন সোনাডাঙ্গাস্থ হেলথ

কেয়ারে নেওয়ার জন্য রওনা হন তারা। কিন্তু পথিমধ্যে একমাত্র ছেলে তাকে

ছেড়ে চলে যায়।’

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওজোপাডিকো’র দেয়াল জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

একাধিকবার বলা সত্ত্বেও কোন কর্ণপাত করেনি তারা। অবশেষে এলাকার মানুষ

একত্রিত হয়ে ২২ মার্চ লিখিত আবেদন করলে তারা কাজ শুরু করে। কিন্তু গলির

মানুষের চলতি পথের রাস্তায় কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি তারা। সকালে

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় শ্রমিকদের বলা হয় যে এখানে পাহারা দেওয়ার

ব্যবস্থা করেন। তারা সেটিও করেনি। এরআগে দেয়াল লাগোয়া নারকেল গাছ থেকে

নারকেল পড়ে তামিমের মায়ের মাথা জখম হয়। সেটিও তাদের জানানো হয়। তখনও তারা

কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পদক্ষেপ নিলে আজ তার তামিমের মৃত্যু হত না। তার বুকের

ধন হরিয়ে গেছে, তিনি আর তাকে কোন দিনও ফিরে পাবেননা। এই বলে অঝরে কাঁদতে

থাকেন তামিমের বাবা।

তামিমের মা সেলিনা বেগম। সন্তান হারিয়ে পাগলের প্রলাপ করছে। যাকে দেখছে

তাকে বলছে আমার তামিককে এনে দাও। কিন্তু তামিমকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা

কারও নেই। তামিমের মায়ের আর্তনাদ ও চোখের পানি দেখে ওই করিমনগরের সুর

মোহাম্মাদ গলির কেউ চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি। ছেলেটির অকাল মৃত্যুর

ঘটনাকে স্বজনরাসহ কেউই মেনে নিতে পারছেনা।

ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় বোন সুমাইয়া সকলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন,

“এহন দেয়াল করবেন। কিন্তু আগেই ঠিক করতে পারেন নাই। আমার ভাই যে চইলা

গেছে এহন ঠিক করবেন দেয়াল। দেয়াল ঠিক করা থাকলে আমার ভাই আমার কাছে থাকত।

১০ বছর ধরে কচ্ছে ঠিক করতে। কিন্তু তারা করেনাই। একবারেই ঠিক করেনাই।

আমার একটা মাত্র ভাই চইলা গেছে। ওর মতো মানুষ দেয়ালের ভার সহ্য করতে

পারে?”

সুর মোহাম্মাদ গলির বাসিন্দা মো: আনিসুর রহমান জানান, ওজোপাডিকো’র সীমানা

প্রাচীর রাস্তার দিকে ঝুকে পড়েছে। দীর্ঘদিন আবেদনের পর তারা সংস্কারের

কাজ শুরু করে। কিন্তু বাইরে থেকে কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। ভেতর

থেকে বাড়ি দেওয়া মাত্রই প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ে। সেখানে আহত হয়ে তামিম মারা

যায়। এই গলির বাসিন্দাদের এখন একটাই দাবি তাদের সীমানা প্রাচীর রাস্তা

থেকে ৫ ফুট সরিয়ে নির্মাণ করা হোক। যেন তামিমের মতো আর কাউকে অকালে ঝরে

যেতে না হয়।

এদিকে তমিমের মৃত্যুর ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধান

প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের ঐ কমিটিকে আগামী ১০

দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট ওজোপাডিকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিকট জমা

দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আর//দৈনিক দেশতথ্য//১৪ মে-২০২২//