দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি : কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রবীণ রাজনীতিবিদ আব্দুল হামিদ ছাত্রজীবনে জাসদ, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিএনপি, পরে জাতীয় পার্টি এরপর ফের বিএনপি হয়ে এবার আওয়ামী লীগে জায়গা করে নিয়েছেন। তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। সরকার দলীয় স্থানীয় এমপি সরওয়ার জাহান বাদশার শ্বশুর আব্দুল হামিদ বারবার দল বদলের পরেও আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাঁই পেয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন। যখন যে দল সরকারে থাকে তখন সেই দলে তিনিও থাকেন বলে মন্তব্য অনেকের। আব্দুল হামিদের দল বদলের পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে নতুন কমিটি থেকে ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাদের বাদ পড়ার বিষয়টিও।
জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের জমিদার পরিবারের সন্তান আব্দুল হামিদ ১৯৭০ সালে ভেড়ামারা কলেজে অধ্যয়নকালে জাসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই তার দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের পথ চলা শুরু হয়। পরে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন। জিয়াউর রহমানের সরকার আমলে তিনি সর্বপ্রথম আদাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের কাউন্সিলে তিনি উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মনোনীত হন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এলে বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন তিনি। পরে তিনি উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি পদ লাভ করেন। এই দলে থেকে দ্বিতীয় বার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
এরশাদের এই দলটি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দীর্ঘ ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও দলের ভাবসাব ভালো না আন্দাজ করতে পেরে ২০০১ সালে আব্দুল হামিদ পুনরায় ফিরে আসেন আগের দল বিএনপিতে। পরে ২০০৫ সালের কাউন্সিলে তিনি উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মনোনীত হন। খালেদা জিয়ার সরকার আমলে আব্দুল হামিদ আবারো (তৃতীয় বার) ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দৌলতপুর আসন থেকে টানা চতুর্থবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি আহসানুল হক পচা মোল্লা। আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রতিমন্ত্রী পচা মোল্লাকে বিশাল সংবর্ধনা দিয়ে মূলত বিএনপিতে আবার শক্ত অবস্থান করে নেন।
এর আগে ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন আব্দুল হামিদ। তিনি ১৮ হাজার ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী কোরবান আলীর কাছে পরাজিত হন। পরে দ্বিতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পার্টি থেকে অংশ নেন। পান ২৮ হাজার ভোট। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আফাজ উদ্দিন আহমেদ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফাজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপি মনোনীত প্রার্থী, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আলতাফ হোসেনকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু চেষ্টা করেও আফাজ উদ্দিনের কাছে ভিড়তে পারেননি আব্দুল হামিদ। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় মহাজোটের মনোনয়ন পাওয়া আফাজ উদ্দিন আহমেদকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী রেজাউল হক চৌধুরী। এর পরপরই এখানকার আওয়ামী লীগের একাংশের নেতৃত্বে থাকা রেজাউল হক চৌধুরীর হাত ধরে আওয়ামী লীগে আবির্ভাব ঘটে আব্দুল হামিদের। এটি তার চতুর্থবার দল বদল।
মাস দুয়েক আগে দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য আফাজ উদ্দিন আহমেদ করোনায় স্ত্রীসহ মৃত্যুবরণ করার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি, সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ঘোষিত আংশিক কমিটির মাধ্যমে দলীয় কর্মকা- পরিচালিত হয়ে আসলেও সম্প্রতি সরওয়ার জাহান বাদশাহ্কে সভাপতি করে উপজেলা আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। প্রায় ১৭ বছর পরে গঠিত এই কমিটিতে জায়গা করে নেন আব্দুল হামিদ। যা এখানকার সবাইকে এক রকম তাক লাগিয়ে দেয়। শুরু হয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ আব্দুল হামিদের দল বদলের দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস নিয়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা।
অনেকের মতে, উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন সভাপতি সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশার শ্বশুর হওয়ায় আওয়ামী লীগে সদস্য পদ পেতে কোনো রকমের বেগ পেতে হয়নি আব্দুল হামিদকে। প্রথম পর্যায়ে তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদে রাখা হলেও পরে হয়তো তার ভাগ্যে মিলবে এই দলেরও বড় কোনো পদ। আব্দুল হামিদকে সুযোগসন্ধানী নেতা হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে অনেকে মন্তব্য করেন, যখন যে দল সরকারে বা ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলে আব্দুল হামিদও থাকেন সদর্পে। বারবার দল বদল করার বিষয়টি তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জামাই এমপি হওয়ার সুবাদে এবার তার কপাল আরো খুলে গেছে।
দলছুট এই নেতা প্রসঙ্গে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা বলেন, আব্দুল হামিদের দলীয় কর্মকা- সন্তোষজনক মনে না হওয়ায় তাকে উপজেলা বিএনপির সর্বশেষ কমিটিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়নি। তাকে নিয়ে আমরা আগেই যেটা ধারণা করেছিলাম পরবর্তীতে সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাই। এমনকি তিনি বিএনপি থেকে অব্যাহতি না নিয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন। যদিও তার থাকা না থাকায় বিএনপির মতো একটি বড় দলের কিছুই আসে যায় না।
এদিকে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের ২০ মাস পর ঘোষিত উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি থেকে গতবারের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফিরোজ আল মামুন, দৌলতপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রেজওয়ানুল হক রেজু, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রয়াত আফাজ উদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল হুদা পটল, উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক সাবেক সভাপতি প্রয়াত সামসুদ্দিন আহমেদ মালিথার ছেলে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সাক্কির আহমেদ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মইন উদ্দিন মোহনসহ বেশ কয়েকজন ত্যাগী ও সিনিয়র নেতাকে বাদ দেয়া হয়েছে। এতে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমপির শ্বশুর আব্দুল হামিদের পদ পাওয়া নিয়ে মুখরোচক আলোচনার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতার পদবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টিও জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ লাভ করা আব্দুল হামিদ বলেন, সরকারি দলের মাধ্যমেই কেবল দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয়ে থাকে। তাই নিজের এলাকার উন্নয়নের স্বার্থেই কিছু মানুষের সমালোচনা উপেক্ষা করে আমি ক্ষমতাসীন দলে থাকাটাই শ্রেয় মনে করি। তিনি বলেন, জামাইয়ের (এমপি বাদশাহ্) প্রভাবে আমি আওয়ামী লীগের সদস্য পদ পাইনি। দলের সিনিয়র নেতারা সম্মান করে আমাকে এই পদটি দিয়েছেন এ কারণে আমি কৃতজ্ঞ। তবে ভবিষ্যতে আর কোনো দলে যাবো না। যতদিন বাঁচবো বাকি জীবনটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই কাটিয়ে দেব।
কুষ্টিয়া-১ দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. ক. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ বলেন, আমরা নতুন কমিটিতে যাদের নাম সুপারিশ করেছি তা পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়নি। ত্যাগী নেতাদের ছাড়াও আমরা সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানদের কমিটিতে রাখার প্রস্তাবনা দিয়েছি। অন্যরাও তাদের মতো করে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। জেলার নেতৃবৃন্দ এগুলো সমন্বয় করে নতুন এই কমিটি প্রকাশ করেছেন। কমিটিতে কিছুটা অসঙ্গতি থাকায় তা আমার নিজেরও মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরেও সার্বিকভাবে এই কমিটি যথেষ্ট ভালো হয়েছে। শ্বশুর আব্দুল হামিদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে, সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ বলেন, তিনি সদস্য হয়েছেন এটা অস্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করারও কিছু নেই।

Discussion about this post