রাশেদুজ্জামান,নওগাঁ প্রতিনিধি:
উত্তরের শষ্যভান্ডার খ্যাত জেলা নওগাঁয় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ বাড়তে শুরু করেছে। লাভজনক হওয়ায় ফুলের নার্সারী গড়ে তুলতে ঝুঁকছেন তরুণ উদ্যোক্তারা। শীত আসলেই বাহারী রঙের ফুলে এসব নার্সারীর সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণে। এসব ফুলের চাহিদা সারাবছর কমবেশি থাকলেও ফেব্রয়ারি মাস জুড়ে ব্যাপক হারে চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই বাড়তি দাম পেতে এ মাসকে ঘিরে ফুলের যতে নার্সারীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। চলতি মাসে পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও মাতৃভাষা দিবসে জেলার নার্সারীগুলো থেকে কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নওগাঁ শহর সংলগ্ন সদর উপজেলার হাঁপানিয়া ইউনিয়নের লখাইজানি, তারতা ও উল্লাসপুর গ্রামে ১ দশক আগে কোন নার্সারী না থাকলেও বর্তমানে সেখানে প্রায় ২শ বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও ফলের নার্সারী। এমন বৈশ্যিষ্টের কারণে স্থানীয়দের কাছে এই তিনটি গ্রাম এখন নার্সারী গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব নার্সারীর মধ্যে প্রায় ১শ বিঘা জমিতে রয়েছে ফুলের নার্সারী। যেখানে তাজমহল, ইরানি, মেরিন্ডা, লিংকন, টাটা, ডিলাইট, থাই জাতের গোলাপ ও গাঁদা ফুলের চাষ করেছেন ৩০ জনেরও বেশি নার্সারী উদ্যোক্তা। এসব ফুলের বাগানে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিচর্যা ও ফুল তোলার কাজ করেন প্রায় ২০০ জন নার্সারী শ্রমিক। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব ফুল পাশ্ববর্তী জয়পুরহাট, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় সরবরাহ করেন উদ্যোক্তারা। যেখান থেকে প্রতি বছর ফুল বিক্রিতেই ৫ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। তবে এরমধ্যে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় ফেব্রয়ারীতেই।
লখাইজানী গ্রামের সোহেল নার্সারির স্বত্ত¡াধিকারী তরুণ উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, শৈশবে বাবাকে দেখেছি তিনি ভ্যান চালিয়ে অন্যের নার্সারীর ফুল শহরের বিভিন্ন দোকানে পরিবহন করতো। সেখান থেকেই ফুলের ব্যবসায় লাভ-লোকসানের হিসাব সম্পর্কে ধারনা চলে আসে। নিজেদের জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফুল চাষ শুরু করলাম। বর্তমানে বর্গা নেয়া ১০ বিঘা জমিতে আমার গোলাপ ও গাঁদা ফুলের বাগান রয়েছে। যেখান থেকে প্রতি বছর ফুল বিক্রি করেই কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা আয় হয়। এই মাসের শুরু থেকেই গোলাপ ফুল পাইকারিতে ৮ টাকা ও গাঁদা ফুল ৫০ পয়সা পিস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকদিন পর গোলাপ ফুল ১৫-২০ টাকা এবং গাঁদা ফুল ১ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হবে। সেই হিসেবে এ মাসে ফুল বিক্রি করে কমপক্ষে ২ লক্ষ টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন তিনি।
একই গ্রামের নাহিম নার্সারীর স্বত্তধিকারী সেলিম মন্ডল বলেন, নার্সারী ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় গ্রামের অনেকেই এখন এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাঁদের দেখেই আমি ৫ বিঘা জমিতে ৬টি জাতের গোলাপ চাষ করেছি। আমার নার্সারী থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৭-৮ লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হয়। যেখানে সব খরচ বাদে কমপক্ষে ৬ লক্ষ টাকা লাভ হয়। এছাড়াও কাটিং কলম বিক্রি করে বাড়তি ৪ লক্ষ টাকা আয় হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে এসব ফুল ও কাটিং কলম সরবরাহ করা হয়। চলতি মাসে আমাদের ৩টি গ্রামের ২৮ জন ফুলচাষীর প্রায় ১ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারীভাবে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে ব্যবসাটিকে আরো সম্প্রসারিত করবেন বলে জানান তিনি।
শহরের ফুলপট্টি এলাকার তরফদার ফ্লাওয়ার শপ অ্যান্ড ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর স্বত্তাধিকারী রায়হান তরফদার বলেন, নতুন বছরের শুরু থেকেই এবার ফুলের চাহিদা অনেক বেড়েছে। সেই সাথে শীতকালে বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিমান ছিলো উল্লেখযোগ্য। তাই চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় এখন ফুলের দাম অনেক বেশি। ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুনকে ঘিরে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। স্থানীয় ফুল চাষীদের কাছ থেকে গোলাপ, গাঁদা, কাটবেলী ও জিপসি ফুল সংগ্রহ করা হয়। তবে জারবেরা, গাডিওলাস, রজনিগন্ধা, অর্কিডসহ অন্যান্য ফুল জেলার বাহিরে যশোর, ঝিনাইদহ ও ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ মাসে শহরের ৪টি দোকানে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
সাপাহার উপজেলার হাসপাতাল মোড় এলাকার স্টার ফুলঘরের স্বত্তাধিকারী আবু বকর সিদ্দিক বলেন, করোনা মহামারিতে দীর্ঘ বছর ব্যবসায় মন্দার পর এবার আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফুলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি পিছ গোলাপ ১০-১৫ টাকা ও গাঁদা প্রতি পিছ ১ টাকা দরে বিক্রি করছি। চলতি মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশাবাদী তিনি।
নওগাঁ জেলা কৃষি সপ্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ,কে,এম মনজুরে মাওলা বলেন, লাভজনক এবং চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় প্রতিবছরই জেলায় ফুলের নতুন নতুন নার্সারী গড়ে উঠছে। বর্তমানে জেলাজুড়ে ফুলের বাগানের পরিমাণ প্রায় ৫ হেক্টর। গোলাপ, গাঁদাসহ বিভিন্ন ফুল চাষে কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় প্রকল্পের মাধ্যমে চাষীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের উন্নত জাতের চারা প্রাপ্তিতে সহযোগীতা করা হচ্ছে। ফুল চাষে তরুণ উদ্যোক্তারা অংশ নেয়ার পরিমাণ বাড়লে এখানে ফুল কেন্দ্রিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে কৃষি ঋণ পেতে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিলেন তিনি।
দৈনিক দেশতথ্য//এসএইচ//

Discussion about this post