Print Date & Time : 5 May 2025 Monday 2:59 pm

নিউইয়র্কে লালন উৎসব: শিকড়ে ফেরার অনুপ্রেরণা

নিউইয়র্কে জাঁকজমকপূর্ণভাবে  লালন উৎসব করা হয়েছে। লালন ফকিরের ১৩২তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে লালন পরিষদ ইউএসের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠান করা হয়।  রোববার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে লালন উৎসব উদ্বোধন করেন লালন শিল্পী ফরিদা পারভীন। জামাইকা পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে এ উৎসব চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। ফরিদা পারভীনের গান এবং গাজী আবদুল হাকিমের বংশীতে মুগ্ধ হয়েছেন অন্তত ৫শত প্রবাসী।

লালনগীতির খ্যাতনামা শিল্পী ফরিদা পারভীন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে ও বেলুন উড়িয়ে নিউইয়র্কে প্রথমবারের মতো লালন উৎসবের উদ্বোধন করেন। অক্টোবরের শেষ রোববার, হেমন্তের শেষ। নিউইয়র্কের আবহাওয়া কনকনে ঠান্ডা থাকার কথা। অথচ নিউইয়র্কে ছিল ঝলমলে আলো; সহনীয় তাপমাত্রা। বেলা তিনটায় জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে খোলা আকাশের নিচে লালন উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।

দিনব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র লালন পরিষদ।

উৎসবে যোগ দিতে ঢাকা থেকে নিউইয়র্কে যান ফরিদা পারভীন ও বিশিষ্ট বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম। নিউইয়র্ক ও আশপাশের বাউল সংগীতশিল্পীরাও যুক্ত হয়েছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিলেন প্রবাসী চারুশিল্পীরা। ২১ জন শিল্পীর আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছিল ‘অচিন পাখির খোঁজে’ শিরোনামের একটি চিত্র প্রদর্শনী।

অনুষ্ঠানটি এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যেন সব বয়সের অতিথিরাই লালনের গান এবং তাঁর জীবন ও দর্শনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে পারেন। সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ও সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’ নামের একটি ভিডিওর মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। এতে ঊনবিংশ শতকের সুফি সাধক লালনের জীবন ও কর্মকথা, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পরিচালিত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে লালনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়।

পরে একটি সেমিনারে লালনের জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন লালন বিশেষজ্ঞেরা। মূল বক্তা ছিলেন ফরিদা পারভীন, গাজী আবদুল হাকিম ও গোলাম সারোয়ার হারুন। তাঁরা সমকালীন বিশ্বে লালন কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরেন। লালন ও তাঁর গান নিয়ে নিরীক্ষার নামে বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ফরিদা পারভীন। পরামর্শ দেন এই বাড়াবাড়ি এড়িয়ে চলার।

বক্তারা বলেন, লালন ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। সারা জীবন সাধারণ একজন মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। তাঁকে নিয়ে যে বাড়াবাড়ি, ‘সাঁইজি’ বেঁচে থাকলে তা কখনোই পছন্দ করতেন না। দ্বিতীয় একটি সেমিনারে ক্যাথলিক পাদরি ফাদার মারিনো রিগনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন। এ সময় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লালনগীতি ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেন।

অনুষ্ঠানে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় নতুন প্রজন্মের ছয় প্রতিনিধির অংশগ্রহণে একটি সেমিনার। এসব কিশোর-তরুণ বলেন, নিজের শিকড়ে ফিরে যেতে লালন তাঁদের বিপুলভাবে সাহায্য করেছেন। নবীন এই প্রজন্মের পরিবেশনায় লালনের গান নিয়ে ছিল আশাজাগানিয়া আরেকটি অনুষ্ঠান। অবিকৃত লালনকে আবিষ্কারে তাঁদের আগ্রহ সবাইকে মুগ্ধ করে।

প্রবাসে যে লালনের গানের চর্চা অব্যাহত রয়েছে, তার প্রমাণ ছিল বিশিষ্ট গায়ক শাহ মাহবুবের পরিচালনায় সংগীতানুষ্ঠান সাঁইর বারামখানা। নতুন ও প্রবীণ শিল্পীদের সমন্বিত অংশগ্রহণে এই অনুষ্ঠান দর্শকদের মুগ্ধ করে। প্রবাসের খ্যাতিমান শিল্পী তাজুল ইমাম ও পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী পার্থ সারথি মুখোপাধ্যায় পরিবেশিত লালনের নির্বাচিত গানের মধ্যে দুটি পরিবেশনাও সবাইকে মুগ্ধ করে।

উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিলেন ফরিদা পারভীন ও গাজী আবদুল হাকিম। তাঁদের পরিবেশনা শুনতে দূরদূরান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক দর্শক এসে সমবেত হয়েছিলেন অনুষ্ঠানকেন্দ্রে। ভূপালী রাগের ভিত্তিতে একটি পরিবেশনা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন বাঁশুরিয়া গাজী আবদুল হাকিম। এরপর নিজের পছন্দের একগুচ্ছ গান গেয়ে শোনান ফরিদা পারভীন। সঙ্গে ছিল লালনের গান ও দর্শন নিয়ে এই প্রবীণ শিল্পীর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ।

উৎসবের আহ্বায়ক মো. আব্দুল হামিদ বলেন, প্রতি বছর এই উৎসবের আয়োজন করব। আগামী প্রজন্মের মধ্যে এবং সারা বিশ্বে লালনের দর্শন ছড়িয়ে দিতে চাই আমরা। লালন উৎসবের প্রধান উপদেষ্টা নূরুল আমিন বাবু এবং সমন্বয়কারীদের মধ্যে ছিলেন হাসানুজ্জামান সাকী, গোপাল সান্যাল, স্বীকৃতি বড়ুয়া, দীনেশ চন্দ্র মজুমদার ও সুখেন গমেজ।

প্রায় মধ্যরাতে শেষ হয় নিউইয়র্কে প্রথম লালন উৎসব। আনন্দঘন এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উত্তর আমেরিকায় লালনচর্চার এক নতুন মাত্রা যোগ হলো। যুক্তরাষ্ট্র লালন পরিষদ জানিয়েছে, প্রতিবছর তারা এই উৎসবের আয়োজন করবে।

এবি//দৈনিক দেশতথ্য//নভেম্বর ০২,২০২২//