অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনঃ নেতার সেবক গান্ধেজ আলী মস্ত বড় ঠিকাদার: খায়েস জনপ্রতিনিধি হওয়ার
আতর থেকে-গন্ধম। গন্ধম থেকে গান্ধেজ আলী ঠিকাদার।
এখন সে হতে চাই মেয়র, চেয়ারম্যান কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান। নেতায় চাইলে আগামীতে হতে পারে এমপি গান্ধেজ আলী।
গান্ধেজ আলী ছোট্র একটি শহরের বাসিন্দা। এই শহরটি হেঁটে পার হতে লাগে বড় জোর তিরিশ মিনিট। সেই শহরের বাহার না থাকলেও পার্টি অফিস খোলা থাকে রাতদিন। ওই পার্টি অফিসের পাশের একটি দোকানে এক সময় টি-বয়ের কাজ করতো বর্তমানের গান্ধেজ আলী।
এই শহরের একপ্রান্তের খাস জমিতে পলিথিনে ছাঁওয়া দমবন্ধ বেলুনের মত একখান ঘর। সেই বেলুন ঘরে জুনের তালপাকা গরমে গান্ধেজ আলীর জন্ম। ঘামে স্নাত গান্ধেজের গন্ধ মায়ের কাছে সুঘ্রান হলেও বাবার কাছে তা ছিলো অসহনীয়। ঘামের দুর্গন্ধ তাড়াতে মা তার নাম রাখলেন আতর আলী। ছেলের গায়ের গন্ধের সাথে মিল রেখে বাবা বললেন ছেলের নাম গন্ধম আলী।
ছয় বছর পার না হতেই মা তাকে স্কুলে না দিয়ে পাঠালেন চায়ের দোকানে। সেই থেকে দোকান বা অফিসে চা পৌঁছে দেয়াই ছিলো গন্ধমের কাজ।
অবিরাম ঘেমে যাওয়ায় এক সময় কে যে তাকে গন্ধম আলী থেকে গান্ধেজ আলী বানিয়ে দিলো তা আজোও অজ্ঞাত।
নামে কি-ই-বা আসে যায়। বড় নেতারা পার্টি অফিসে আসলে তার ডাক পড়ে। চা পৌঁছে দেয়ার পর পানচুরুট, তারপর জুতো ধুঁয়েমুছে কালিকুলি লাগানোর অর্ডার। গান্ধেজ পরম যত্নে সেসব করে। এভাবে দিন যায়, মাস আসে। মাস যায় বছর আসে। দিন, মাস আর বছরের পরিক্রমার আবর্তে নেতার ভাগ্যের সাথে গান্ধেজের ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়।
তার নেতা রিকসা ছেড়ে এখন দামী গাড়ি হাঁকিয়ে পার্টি অফিসে আসেন। গান্ধেজও এখন সবক্ষণ নেতার সঙ্গেই থাকেন। দলের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তাকে একটি পদ দেয়া হয়েছে। গান্ধেজ বছর কয়েক আগে একটা কনস্ট্রাকশন ফার্ম খুলেছেন। নাম গন্ধরাজ কনস্ট্রাকশন ফার্ম।
পার্টি অফিসে নেতার পাশেই গান্ধেজ নিজের জন্য সংরক্ষিত করে নিয়েছে একখান চেয়ার।
দলীয় সভাসমাবেশের মঞ্চে গান্ধেজ নেতার পাশে বসেন। বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন। বক্তৃতায় ডাকার আগে ঘোষক মাইক্রোফোনে নাম পরিচয়ে বলেন, অমুক দলের, অমুক নেতার পরীক্ষিত সৈনিক এবং গন্ধরাজ কনস্ট্রাকশন ফার্মের কর্ণধার আতর আলী গন্ধম ওরফে গান্ধেজ ভাই এখন বক্তব্য রাখবেন।
গান্ধেজ এখন ছোট শহরের নামকরা নেতা, ঠিকাদার। সামনে উপজেলা পরিষদ অথবা পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে তার নামে শহরে চিকামারা হচ্ছে।
ঠিকাদার গান্ধেজ যে হাত দিয়ে চা বানাতেন, নেতার পানচুরুট আনতেন অথবা চটি জুতোতে কালিঝুঁলি করাতেন, সেই হাত দিয়ে এখন বড় বড় অট্রালিকা, ব্রীজ, অডোটরিয়াম, স্কুল ভবন, পাকা রাস্তা বা সরকারি স্থাপনা বানান।
তাই কালভার্ট বা ব্রীজে রডের পরিবর্তে বাঁশ, পাঁকা সড়কে বালির পরিবর্তে মাটি, সিমেন্টের পরিবর্তে বালি দিয়ে ভবন নির্মাণ করেন গান্ধেজ।
দশকের পর দশক রাজনৈতিক বিবর্তনে উপর তলায় উল্টাপাল্টা বা পরিবর্তন হয়। সেসব পরিবর্তনে মানুষ খুশিও হয়। হয়তো ভাবেন এবার তাদের সরকার এসেছে।
কিন্তু উপরতলায় যাই কিছু ঘটুক, নিচ তলায় গান্ধেজ আলীদের কোন পরিবর্তন হয়না। গান্ধেজ চরিত্র সব সময় বিরাজমান থাকে। এক গান্ধেজ যায়, আরেক গান্ধেজ আসে। কিন্তু রডের পরিবর্তে বাঁশ, অথবা বালির পরিবর্তে মাটি দেয়া বন্ধ হয়না। এভাবেই চলে গান্ধেজদের জয়জয়কার।
রাজনীতি থেকে এইসব গান্ধেজদের সরিয়ে না দিলে বন্ধ হবেনা রডের পরিবর্তে বাঁশ ও সিমেন্টের পরিবর্তে বালি দেওয়ার কাজ। এরজন্য রাজনীতিতে লাগবে শদ্ধি অভিযান। আর এই অভিযান কোন নেতা নয়, পারবে কেবলমাত্র জনগণ।
আর কিছু না পারি গান্ধেজদের গায়ে চিহ্ন মেরে বলে দিই ওর আসল পরিচয়।
লেখক ঃ জয়নাল আবেদীন, ইতিহাসের অধ্যাপক।
এবি/দৈনিক দেশতথ্য /অক্টোবর ২৭/২০২১।