রাকিবুল ইসলাম তনু, পটুয়াখালী :
‘এ যেন ইটের খোয়া নয়, চুলার মাটি। রাস্তায় এক নম্বর ইটের খোয়া দেয় নাই। এ রাস্তা বেশি দিন টিকবো না। ঠিকাদার রাস্তার কাম হালাইয়া রাহায় চলাচলে দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং দূর্ঘটনায় অনেকের হাত-পা ভাঙছে। রমজানের ঈদের আগে দুই ট্রাক চুলার মাটি (খোয়া) হালাইয়া গ্যাছে, হেরপর আর ঠিকাদারের হদিস নেই, গত দুই মাস ধইর্যা লাপাত্ত তিনি।
পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার বগা-কাছিপাড়া সড়কের বৌলতলী ব্রিজ বাজার রাস্তার নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও দীর্ঘ পাঁচ বছরেও কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন বৌলতলী গ্রামের সত্তুরোর্ধ্ব মো. নূর ইসলাম সিকদার।
পশ্চিম বীরপাশা গ্রামের মো. মনির হোসেন হাওলাদার (৫২) বলেন, ‘দীর্ঘ ৫/৬ বছর ধইর্যা রাস্তার কাম হালাইয়া রাখায় মোগো চরম ভোগান্তি হচ্ছে। এই রাস্তা দিয়া যাতায়াত কইর্যা আমার দুই পোলার হাত ভাঙছে। এতে দেড় লাখ টাকা লাগছে চিকিৎসা করাইতে। এছাড়া অটোবাইক দূর্ঘটনায় মোর চাচা ও ফুফা হাত-পা ভাইঙা দীর্ঘদিন ঘরে পইর্যা ছিল’।
বীরপাশা গ্রামের মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘রাস্তা ও কালভার্টের যেটুকু কাম হইছে তা খুবই নিম্নমানের। ঠিকাদারকে কিছু কইলে হে ক্ষমতার দাপট দেহায় এবং কয় হামনেরা যা করতে পারেন কইরেন গিয়া।
পশ্চিম বীরপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইশরাতুল জাইমা, পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার বলে, ‘বৃষ্টি হলে এ রাস্তায় পানি জমে থাকে। তখন স্কুলে আসা-যাওয়া করতে আমাদের কষ্ট হয় এবং রাস্তার কাদা-পানিতে জামা-কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। আমরা এই রাস্তাটির কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানাচ্ছি’।
বীরপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার ও মো. নাইম হোসেন বলে, ‘গত ৫ বছর ধরে দেখছি এ রাস্তার কাজ চলছে। কাজ শেষ না হওয়ায় চরম ভোগান্তি হচ্ছে এবং স্কুলে আসা-যাওয়ায় ভোগান্তি হচ্ছে। কখনও কখনও ক্লাস না করে ফের বাড়ি চলে যেতে হয়। এতে আমাদের লেখাপড়ার প্রচন্ড ক্ষতি হয়’।
পশ্চিম বীরপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাহিদা সুলতানা ও বীরপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোসা. খাদিজা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার কাজ পড়ে থাকায় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আসা-যাওয়া করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এবং লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে। তাই রাস্তার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা জরুরী’।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার বগা-কাছিপাড়া সড়কের বৌলতলী বাজার ব্রিজ থেকে ৩ কিলোমিটার রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণের দরপত্র আহবান করে এবং বরিশালের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কোহিনুর অ্যান্ড রুটস্ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ঠিকাদার নিযুক্ত হয়। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে । কিন্তু ঠিকাদারের খামখেয়ালিপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় দীর্ঘ পাঁচ বছরেও কাজ সম্পন্ন হয়নি। এ সড়কটি দিয়ে কনকদিয়া, কালিশুরী ও কাছিপাড়াসহ তিন ইউনিয়নের অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ কাজের ঠিকাদার মিজানুর রহমান মিল্টন শুরু থেকেই কাজ করা নিয়ে গফিলতি করেন এবং গত পাঁচ বছরে মাত্র ২৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছেন। অথচ ইতোমধ্যে ৯৪ লাখ টাকা অগ্রীম বিল উত্তোলন করে নিয়েছেন তিনি। কাজের মান নিয়েও রয়েছে স্থানীয়দের বিস্তর অভিযোগ। নিম্নমানের ইট ও খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
এ ব্যাপারে স্থানীয় কনকদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহীন হাওলাদার বলেন, ‘ মিল্টন নামের এই ঠিকাদার এর আগেও দু’টি প্রকল্পের কাজ নিয়ে গাফিলতি করেছেন এবং দীর্ঘদিন ফেলেও রেখেছিলেন। তারপরও তাকে ফের কাজ দেওয়া হলো কেন ? তাকে কাজ দেওয়ার কারণে আজ এই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার মানুষ এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চায়’।
বরিশাল কোহিনুর অ্যান্ড রুটস্ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ঠিকাদার মো. মিজানুর রহমান মিল্টন বলেন, ‘করোনার মহামারী ও আম্পানসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হয়েছে। শিগগিরিই এ কাজটি সম্পন্ন করে ফেলবো’।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ লতিফ হোসেন জানান, এলাকার মানুষের সুবিধার্থে সড়কটির কাজ দ্রত শেষ করা হবে এবং একই সঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দৈনিক দেশতথ্য// এইচ//