শেখ দীন মাহমুদ,খুলনা প্রতিনিধি: খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনিতে স্থাপত্যকাঠামো ও প্রাচীণ আমলের নানা প্রত্নবস্তু উদ্ধার করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, স্থাপনাগুলো নবম থেকে দ্বাদশ শতকের। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে প্রাপ্ত নমুনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উঠে আসতে পারে সুনির্দিষ্ট শাসনামলের সময়কাল, প্রাচীণ স্থাপত্যশৈলী এবং সেখানে বসবাসকারীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা। স্থানীয়রা বলছেন, আশপাশের কয়েকটি গ্রামজুড়ে রয়েছে এমন অনেক পুরনো ঢিবি।
মাত্র এক মাস বরাদ্দের খননে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নের রেজাকপুর শিংয়েরবাড়ি ঢিবিতে খুলনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননে দৃশ্যমান নবম হতে দ্বাদশ শতকের স্থাপত্যকাঠামো। ইতোমধ্যে সেখানকার পাওয়াগেছে, প্রাচীণ আমলের বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পোড়া মাটির ফলক, প্রতীমার ভগ্নাংশ, অলংকৃত ইট, বিনিময় মাধ্যম কড়িসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতত্ত্ব বস্তু।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননের সফলতা নীরিক্ষণপূর্বক পরিদর্শনে গত ২৩ এপ্রিল অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পন্ডিত খননস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় অধিদপ্তরের উপরিচালক (প্রশাসন) মাইনুর রহিম, উপপরিচালক (প্রত্ন.) ড. মো. আমিরুজ্জামান, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয়, খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, কাস্টোডিয়ান বাগেরহাট মোহাম্মদ যায়েদ, ফিল্ড অফিসার মো. আল আমীনসহ খনন টিমের সদস্যবৃন্দ, খনন শ্রমিকগণ ও স্থানীয় ভূমি মালিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, কপিলমুনিস্থ সিংয়ের বাড়ি ঢিবি খননে দৃশ্যমান স্থাপত্যকাঠামোর দৈর্ঘ্য আনুমানিক ২৫০ মিটার ও প্রস্থ ১৮০ মিটার। ঢিবির দক্ষিণাংশ খননে একটি বর্গাকার স্থাপত্যকাঠামো স্পষ্ট। যেখানে একটি বর্গাকার কক্ষ উঠে এসেছে। কক্ষটিকে ঘিরে দেওয়াল দিয়ে বেষ্ঠিত একটি প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। মূল কাঠামোর কোণগুলোতে কোণিকভাবে প্রসারিত দেওয়াল পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরো বেশি স্থানজুড়ে খনন কার্যক্রম প্রসারিত হলে এর স্বরুপ ও প্রকৃতির সঠিক অনুমান সম্ভব।
কাস্টোডিয়ান বাগেরহাট ও উক্ত খননকাজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ যায়েদ জানান, উদ্ঘাটিত স্থাপত্যকাঠামোর উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব কোণের প্রদক্ষিণ পথের বাইরের দেওয়ালের সাথে মাটির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় খাদ্যবস্তু কালো রঙের চালের ডিপোজিট পাওয়া গেছে। এই চালের উপর গবেষণা করলে তৎকালীণ সময়ের ধানের প্রজাতি ও প্রতিবেশের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
খনন কার্যক্রমের প্রথম দিকে স্থাপত্যকাঠামো দেখে সেটি প্রাচীণ বৌদ্ধ আমলের নিদর্শন বলে ধারণা করা হলেও পর্যায়ক্রমে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু দেখে এর সঠিক সময়কাল সম্পর্কে এখনি বলা মুশকিল। তবে এটি কোন ধর্মীয় উপাসনালয় বলে ধারণা করা হলেও ঠিক কোন সময়ের তা বলা যাচ্ছেনা। বিশেষ করে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য ও ধারণায় বদল ঘটাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে মধ্য ও আদি-মধ্যযুগর একগুচ্ছ প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন রয়েছে। ইউনিয়নটির কয়েকটি মৌজায় যেমন, কপিলমুনি, রেজাকপুর, রামনগর ও কাশিমনগরসহ বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে রয়েছে। সাম্প্রতিক মানব বসতির সম্প্রসারণ ও চাষাবাদের ফলে অনেক এলাকার প্রত্নস্থান ও বস্তু বিলুপ্ত হয়েছে। কিংবা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা আরো জানান, পুরো এলাকার স্থাপনাগুলি দীর্ঘ দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে এলাকাবাসী বিক্ষিপ্তভাবে (অপরিকল্পিত উপায়ে) এখানকার ইট উঠিয়ে আধুনিক স্থাপনাসমূহে এর ব্যবহার শুর” করে। এসব খননে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ইট, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, প্রাণীর হাঁড় উঠে আসে। সর্বশেষ প্রাচীনকালে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে পাইকগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় জরিপ ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জরিপ শেষে শনাক্তকৃত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যিক ঢিবিগুলোর মধ্যে শিংয়ের বাড়ি রেজাকপুর কপিলমুনি ঢিবিটিকে নির্বাচন করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব রতন চন্দ্র পন্ডিত’র সার্বিক নির্দেশনায় পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত হিসেবে রয়েছেন, বাগেরহাট যাদুঘরের কস্টোডিয়ান মো.যায়েদ। দীর্ঘ দিনের এই অঞ্চলে কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় খননকাজে পরামর্শ প্রদান করছেন, সিলেট ও চট্টগ্রামের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান। এছাড়া পরামর্শক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্বাধীন সেন।
দৈনিক দেশতথ্য//এল//

Discussion about this post