
এসএম জামাল :
মা’কে আমি যেভাবে দেখেছি তা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলতে চাই,
ছোট্ট এ শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম দরদ। তাইতো মমতাময়ী মায়ের সম্মানে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালন করা হয়।
আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মায়ের অবদান অনেক বেশি! স্যালুট মা তোমাকে।
দাঁত থাকতে যেমন দাঁতের মর্যাদা বোঝে না, ঠিক তেমনি মা বেঁচে থাকলে যতবার না ডাকি মৃত্যুর পর মা মা বলে অস্থির হয়ে ওঠে মনপ্রাণ। মনে হয় মা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে না কতই না ভালো হতো। কিন্তু মায়ের জীবদ্দশায় মা বলে সেভাবে ডাকা কমই হয়েছে বলে মনে হয় কখনো কখনো। তবুও মায়ের প্রতি মমত্ববোধ, ভালোবাসা অগাধ বিশ্বাস সকল সন্তানের চিন্তাচেতনায় আছে এবং থাকবে। যদিওবা আমার মা এই নশ্বর পৃথিবীতে আজও বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকুক আরও বহুদিন বহুবছর।
‘মা’ ছোট্ট একটি শব্দ কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ডাক। ছোট্ট এ শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাইতো মমতাময়ী মায়ের সম্মানে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালন করা হয়। তবে অনেকের মতে, মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণ প্রয়োজন হয়। মায়ের প্রতি প্রতিদিনই সন্তানের ভালোবাসা থাকে।
আমরা দিনে কয়বার মাকে ‘মা’ বলে ডেকেছি। ফলাফল খুবই নিম্ন হবে। এটা অসম্ভব কিংবা অবাস্তব কিছু নয়। আমরা যতটাই বড় হচ্ছি ততটাই মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
এমনও সন্তান রয়েছে যাদের মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে রাত কাটায়। হায়রে মা! ক্ষমা করে দিও তাদের। যেদিন তুমি থাকবে না সেদিন হয়তো তোমাকে অনেক অনেক খুঁজবো আমরা, কিন্তু পাবো না। আজ পেয়ে হারিয়ে ফেলছি মাকে। তবু জানি সন্তান মাকে কষ্ট দিয়ে থাকলেও মা সেটা ভুলে যাবে এবং সন্তানকে ক্ষমা করে দিবে। এটাই মায়ের নিয়ম। তবুও আজ বলতে চাই, ‘ক্ষমা করে দিও মাগো’। মা তোমায় সত্যি ভীষণ ভালোবাসি। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।
আমার মা তো জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া এক সৈনিক। একেতো বাবা ছিলো কথা বলতে না পারা মানুষ (বাকও শ্রবণ প্রতিবন্ধী)। তারপরও সংসার নামক ঘানি টানতে টানতে আজ জীবনসায়াহ্নে এসে থমকে আছে। তবুও একটু ক্লেশ যাতনাকে লঘুচিত্তে বহন করেও সানন্দে তাঁদের দাম্পত্য জীবন পার করে যাচ্ছে।
টিভি নাটক সিনেমা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রেম ভালোবাসার আবেগময় উপস্থিতিকে দেখি আর ভাবি একটা মানুষের জন্য বিপরীত মানুষের প্রেম প্রীতি আস্থা বিশ্বাস আর ভালোবাসার অবগাহন যখন দুজন দুজনের মধ্যে আদান-প্রদান ঘটবে তখনই চালচিত্র নির্মোহ দৃষ্টিতে ফুটে উঠবে। ঠিক তদরুপ আমার মা বাবা-মায়ের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঠিক উল্টো। কারণ মা দেখতে শুনতেও অনন্য। এলাকার আভিজাত্যপূর্ণ পরিবারে বেড়ে ওঠা। আভিজাত্যপূর্ণ পরিবার বলতে মায়ের বাবার গোলা ভরা ধান, গরুর ঘানি সরিষার তেল ভাঙানোর কল, মাঠে অনেক জমাজমি এসব কারনেই এলাকার মধ্যে প্রভাবশালী আমার নানার নাম (কুটি শাহ)। যায় হোক বাবার সাথে বিয়ের পর থেকে অনেকেই অনেক কথা বলেছিলো বাবার বিষয় নিয়ে। কারন বাবা আমার বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধী হওয়ায় সংসার করবে কিভাবে। তবুও মা আমার করও কথা না শুনে মুখ বুজে সহ্য করে এ জীবন টা পার করে দিলো। জীবনের জয়গানে মা-বাবাকে অনেক কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বাবা কাঠের (ফার্ণিচার) কাজ করতেন। সকাল থেকে রাত অবধি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। যাতে করে সংসারটা একটু ঘুরে দাঁড়ায়। আমার আজও মনে আছে যখন আমি ক্লাস টুতে পড়ি সেসময় আমরা একটা টিনের চালের ছাপড়া ঘরে থাকতাম। চারদিকের বেড়াটি ছিলো বাঁশের কুঞ্চিকার সমন্বয়ে মাটির প্রলেপ দেওয়া বেড়া ঘেরায় উপরে টিনের চালা ঘরে (ছাপড়া)য় বসবাস। ঝড়বৃষ্টি আসলে তখন কি যে কান্নাকাটি করতাম। ঠিক সেসময় দেখতাম মা বাড়ীতে মুরগী পালন করতো। তা থেকে ডিম বিক্রি ছাগল পালন করে তা থেকে বাচ্চা আবার অনেক পরে গরু পালন করতো। তাছাড়াও বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক সবজির আবাদ করতো। একবার তো লাউয়ের (কদু)র আবাদ করে এলাকায় তাক লাগিয়েছিলো। শত শত কদু তখন বিক্রি করতে হতো আটানা (৫০ পয়শা) থেকে দুই টাকা পর্যন্ত। ব্যাপক আবাদ হয়েছিলো সেসময়। এভাবেই বাবার পাশাপাশি মায়ের কষ্টে সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে পরিশ্রম করে গেছেন তারা। এভাবেই সেই টিনের চালার ছাপড়া থেকে মাটির দেওয়াল ঘর তারপর এখন তো পাকা বাড়ীতে আরাম আয়েশে থাকছি আমরা। এভাবেই গ্রামের বাড়ীতে সবচেয়ে প্রথম সাদাকালো টেলিভিশন আমার বাড়ীতে সেই ১৯৯৬ সালে,, তারপর রঙীন টিভিও প্রথম আমার বাড়ীতে, এভাবেই ফ্রীজ, মোটরে পানি তোলা টাঙ্কিতে পানি রাখাসহ সবকিছুই আমাদের পাড়ায় সবার আগে এসেছে। এতো সুখের জন্য মা-বাবার এ অনন্য অবদান কোনদিনও ভুলবো না। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে অনেক। তবে মায়ের কারণে সংসার টি সুন্দর সুচারুভাবে পারিচালনা করে এসেছে।
তাছাড়া তো একটু একটু করে জমানো টাকা দিয়ে বছর বছরে কিছু জমি কেনা। তবে সবসময়ই দেখতাম জমি কিনলে তা রেজিস্ট্রির সময় বাবা এবং মায়ের নামে জমিও কেনা হতো। আমাকে পড়াশোনা করিয়েছে। আমার ছোট দুটি বোনকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। তাদের সুন্দরভাবে বিয়ে দিয়ে ঘর সাজিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমি মনে করি এতোসব হয়েছে কেবলই আমার মায়ের কারণে। মা যদি সংসার নামক ঘানি টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়তো তে থমকে যেতে হতো এই আমাদের। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে মায়ের কল্যানে তা কেবল সত্য, সুন্দর এবং সামাজিকভাবে বসবাস করছি।
এভাবেই চলছে আমি ও আমার জীবন। মাকে স্যালুট জানাই আজ আমি ও আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে যে ভূমিকা পালন করেছে বলে। কারন, বাবা পড়াশোনা জানা তো দূরে থাকুক কথা বলতে না পারায় মা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতো। বাড়ীর পাশে শিল্পী বু, ঝর্ণা মামীর কাছে পড়ালেখার হাতেখড়ি। তা কেবল মায়ের কারনেই হয়েছিলো। চৈত্র বৈশাখ মাসে মাৈর সাথে ভরদুপুরে ঘুমিয়ে থাকা এই আমি কৌশলে ঘুম না এসে মায়ের কোল থেকে পালিয়ে পাড়ার ওপারে গিয়ে ডাংগুলি ও মার্বেল খেলায় মেতে ওঠা এই আমাকে আবার পরে এ পাড়া ও পাড়া করে ঘুরে খুঁজে এনে পিটুনী দেওয়া সত্যি এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমার ছোটখাটো অপরাধের জন্য মা পিটুনী খেয়েছে বাবার হাতে। দুষ্টুর কোন কমতিই ছিলো না আমার কাছে। তবুও বাবা-মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে ওঠা এই আমি কখনো তাদের মুখের ওপর কথা বলিনি, অসাদাচারণ করিনি। কারন সাহস হয়নি আমার। আমার স্পর্ধা নেই তাদের সাথে খারাপ আচরণ করার। তারপরও মনে হয় মা, আমি জানি বড্ড কষ্ট দিই তোমাকে! মাঝেমধ্যে খুব খারাপ আচরণ করি! জানি মা, তোমার খুব দুঃখ লাগে! আমারও অনেক খারাপ লাগে, অনুশোচনায় কষ্ট পাই। তবু তোমাকে কখনো জড়িয়ে ধরে বলা হয়নি, মাফ করে দাও আমাকে! আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিব না মা।
তবে আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমার মা আমার জীবনে ধ্রুবক ছিলেন। তিনি আমাকে একাই বড় করেছেন। কারন বাবা সারাটাদিন কাজের জন্য বাইরে থাকার জন্য মায়ের অবদান অনেক।
কখনো টিফিনের টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য কিছু কেনা হয়নি, দেওয়া হয়নি কিছু। তবু সেই মা-ই তাঁর সর্বোচ্চটা আমাদের দিয়ে দেন। যখন কোনো কারণে মায়ের চোখে অশ্রু দেখি, বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই। মনে মনে ভাবি, ওনার এত দুঃখ কেন? ইচ্ছা করে ম্যাজিক করে মায়ের দুঃখগুলোকে ফুল বানিয়ে দিই। চিরকালের জন্য ছুটি দিয়ে দিই কষ্টগুলোকে। যদি কখনো মায়ের মুখে একটুখানি হাসি দেখি, তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। আমার সব সুখ তোমাকে ঘিরেই মা। মা এক অনন্য, তিনি আপনাকে তার ভালোবাসা, তার প্রার্থনা এবং আপনাকে পথ দেখানোর শক্তি দিয়ে পাঠান। মা ও মেয়ের ভালোবাসা কখনো আলাদা হয় না। মায়েরা কখনই অবসর গ্রহণ করেন না, তার সন্তানের বয়স যতোই হোক না কেন, তিনি সর্বদাই একজন মা। সর্বদা তার সন্তানদের, যে কোনও উপায়ে উত্সাহিত করতে এবং সাহায্য করতে ইচ্ছুক!
এবি//দৈনিক দেশতথ্য //১২ মে,২০২৪//

Discussion about this post