স্মৃতির জানালা খুলে দূর প্রবাস থেকে মন ভরে বাংলাদেশকে দেখি

স্মৃতির জানালা খুলে অনেক দূরের প্রবাস থেকে মন ভরে বাংলাদেশকে দেখি। আজও দেখতে পায় বহু বছর আগে ফেলে আসা দৃশ্যগুলো। প্রখ্যাত শিল্পি ভূপেন হাজারিকার একটি গানের সুর প্যারেডিী করে বলতে ইচ্ছে করে “ব্রিটিশ আর দেয় না হানা, নেই তো পাকিস্তানের অত্যাচার।
তারপরও প্রতিদিন কেন শুনি দেশজুড়ে শুধু ধর্ষণ, ভণ্ডামি আর গুণ্ডামি কারবার। ভেবেছিলাম দেশ তো স্বাধীন। এখন সবাই ভালোই আছে। কিন্তু এখনও অনেকে একমুঠো ভাত খেতে পায় না। এটা কি তাহলে আমাদের ব্যর্থতা!
কঠিন সংগ্রাম করে সবাই মিলে দেশটি স্বাধীন করেছিলাম। আর আজ দেশে ধর্ষণ, হত্যার খবর আমাদের বিচলিত করে। আমরা ১৯৭১ সালে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করতে শপথ নিয়েছিলাম । আমরা কি সেই শপথ পালন করতে পারছি?
মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। তিনি বলেছিলেন “মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বিদেশী অপশাসনের কবল থেকে দেশকে আমরা মুক্ত করেছি। তারপর কি হয়েছে বা হচ্ছে তা কারো অজানা নয়।
আমি দায়িত্বের সাথে চিৎকার করে বলতে চায়, আমি স্যাটেলাইট চাইনা, আমি ফোর বা ফাইভ জি চাইনা। আমি দুমুঠো ভাত, পরনে বস্ত্র, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, বাসস্থান এবং শিক্ষা চাই। আমাকে আগে আমার এই নূন্যতম চাহিদাটুকু পূরণ করতে সক্ষম হতে হবে। দেশের মানুষকে বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে শেষ করে আমরা স্বাধীনতার পতাকা উড়াবো আর অন্যদিকে মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বে বেঁচে থাকার জন্য তা কীভাবে সম্ভব?
আমার দেশে কালো পতাকা উড়বে লাল সবুজের পতাকার পাশে একই সময় তাকি ভালো দেখাবে? হয়ত কথা উঠতে পারে কি হচ্ছে ইউরোপে? পুতিনের ইউক্রেন হামলার নিন্দা আমরা সবাই করছি ঠিকই কিন্তু আমেরিকার মত ইউরোপেও বিশ্বের সব দেশের মানুষের বাস সেখানে। তবে বোঝা যায় এখানেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রয়েছে। ধনী-গরীব, ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ এগুলো বিশ্বের সর্বত্র বড় আকারে প্রভাব ফেলে চলেছে।
আমরা দিন দিন গ্লোবালাইজড হচ্ছি আর মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করছি। আমি প্রায়ই বলে থাকি “to be poor is very expensive.” গরীবের না আছে বন্ধু, না আছে অর্থ। সেক্ষেত্রে সমাজের চোখে সব সময় অবহেলিত, নির্যাতিত এবং হেয় প্রতিপন্ন হয়। বাংলাদেশে ভাষা, বর্ণ ও ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও গরীব হবার কারণে সমাজে এদেরকে তেমন ভালো চোখে দেখা হয় না। আবার একই ভাষা বুকের মাঝে সত্ত্বেও ধর্ষণ, গণহত্যা এবং শেষে মরদেহকে দিবালোকে পুড়িয়ে ফেলতেও বিবেকে কোন বাঁধা নেই। হিংসাত্মক ক্ষমতাবান বৈষম্যবাদী পুঁজিবাদের অন্ধকার হৃদয়কে গ্রাস করেছে। দেশে হত্যার উল্লাসে অনেকে উল্লসিত।
মনে হচ্ছে সকলেই কোনো না কোনো ঘৃণার নেশায় নিমজ্জিত। সকলেই হয় আত্মঘাতী, নয়তো পরঘাতী। অনেকের ধারণা রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন-প্রশাসন ঠিক না করলে মানুষের আচরণ বদলাবে না। দেশের মানুষই যখন ভুলের মাঝে ডুবে আছে, তখন রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন, প্রশাসন ঠিক করবে কারা? বিশ্বের অনেক দেশেই একই অবস্থা। তাছাড়া ধর্ম এবং বর্ণের অমিলে পাশ্চাত্যে হেয় প্রতিপন্ন হবার সম্ভাবনা একটু বেশি। সমাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারলে পার্থক্যটা এতটা চোখে পড়ে না। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ফ্রান্সে।
ওই দেশের লোকসংখ্যার মধ্যে প্রায় এক কোটি মুসলমান। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স সরকারের উচিত হবে না মুষ্টিমেয় বা কতিপয় কিছু মুসলমানদের অমানবিক ব্যবহারের কারণে পুরো মুসলিম জাতিকে অবমাননা করা। অথচ এমনটিই ঘটে চলেছে।
ভারত এবং চীনে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর অমানবিক দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বের করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব দেখছে অথচ তেমন কিছুই করছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ গঠন করা হয়েছে। তবে জর্জরিত, নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। হঠাৎ যখন একটি অঘটন ঘটে, সবাই উত্তেজিত হয়ে কিছুদিন হৈহুল্লোড় করে, পরে সবকিছু শীতল হয়ে যায়।
এভাবে চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না, যার ফলে নিপীড়িত নির্যাতিতের সংখ্যা বেড়ে চলবে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ তেমন কিছু করছে না। সবাই বলতে আমার দৃষ্টিতে যাদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে তাদেরকেই আমি দোষারোপ করছি। মনে রাখা দরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতা এক নয়। মতামত ব্যক্তির মনের মধ্যে সব সময় লুকিয়ে থাকতে পারে না। মতামত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং জ্ঞানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে বিবেক বা চিন্তাচেতনা। নানা কারণে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ সব সময় ঘটে না। তবে চিন্তার যোগ্যতা এবং স্বাধীনতা ছাড়া কেউই দুনিয়ায় তাদের অধিকার কায়েম করতে পারে না। সেক্ষেত্রে দরকার বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার। আমাদের অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা উচিত। তবে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে অবশ্যই সীমারেখা থাকতে হবে এবং তা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। আমাদের অন্যদের প্রতিও সম্মান দেখাতে হবে। ধর্মবিদ্বেষ অসুস্থ মতপ্রকাশের বিকার, চিন্তার স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে সাহায্য করে। আমাদের কাজ হওয়া উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে যেটা সঠিক সেটা মেনে চলা। আমি যেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সেটা যদি অন্য কেউ না করে সেখানে জোর করার কিছু থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে যার যার ধর্ম তার তার কাছে থাকা ভালো। অন্যের ধর্মকে ছোট করা একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের কাজ নয়। তাই আসুন ঘৃণা নয় ভালোবাসা দিয়ে জয় করি এবং জয়ী হই। স্বাধীনতার মাস হোক পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার মাস।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//১১ মার্চ, ২০২২//