মোহাম্মদ সোহেল (টাঙ্গাইল)
প্রাচীণ স্থাপত্যের সৌন্দর্যময় নিদর্শনে বিশাল জায়গাজুড়ে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে আছে হেমনগর জমিদার বাড়ি।
নিপুণ কারুকাজে খচিত অষ্টাদশ শতাব্দীর
প্রাচীন ঐতিহ্য মাথা উঁচু করে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
হেমনগর নামটি হয় মূলত হেম রাজার নাম অনুসারে। তিনি ছিলেন হেমনগরের জমিদার। জমিদারি প্রথা না থাকলেও রয়েছে জমিদারি আমলের নানা স্থাপনা, সান বাঁধানো ঘাট, বিশাল মাঠ, সবুজ প্রকৃতিসহ নানা স্মৃতি।
রসিকরা সেখানে গুণী বাইজির গান ও নাচের আসর উপভোগের জন্য আসতেন। পূজাপার্বণে রাজবাড়িসহ জমিদার বাড়ির দক্ষিণ আঙ্গিনায় আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতো। এখন যেখানে কলেজ মাঠ, যেখানে ছিল দ্বিতল নাট্যশালা। হেমচন্দ্র চৌধুরী এবং তার বংশধররা সবাই ছিলেন উদার সংস্কৃতির সমঝদার।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা শহর থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে হেমনগর গ্রামে অবস্থিত। প্রায় ১২৪ বছর আগে পুখুরিয়া পরগণার প্রভাবশালী জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী নিপুণ শৈলীর এই বাড়িটি তৈরি করেন। তিনি ছিলেন মধুপুর উপজেলার আমবাড়ীয়ার জমিদারের উত্তরসূরি। হেমচন্দ্রের দাদা পদ্মলোচন রায়। ব্রিটিশ আইনের মাধ্যমে আমবাড়ীয়ার জমিদারি প্রাপ্ত হন।
প্রথমে ১৮৮০ সালে হেমচন্দ্র তার আমবাড়ীয়ার জমিদার স্থানান্তরিত করে সুবর্ণখালিতে নির্মাণ করেন। পরে রাজবাড়ীটি যমুনা গর্ভে বিলীন হওয়ায় ১৮৯০ সালে একটি নতুন দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা বর্তমানে জমিদার বাড়ি হিসেবে খ্যাত।
নিপুণ কারুকাজের অনিন্দ্য সুন্দর জমিদার বাড়িটি পরীর দালান নামেও স্থানীয়ভাবে সমধিক পরিচিত।
রাজবাড়ির রাজসিক পরীর ভাস্কর্যের কারণেই এঞ্জেল হাউজ বা পরীর দালান হিসেবেও পরিচিত। জ্যামিতিক এবং ফ্লোরাল নকশায় কারুকার্যমন্ডিত হেমনগর জমিদার বাড়িটি দিল্লি ও কলকাতার কারিগর দ্বারা তৈরি করা হয়। বিশাল জায়গাজুড়ে দ্বিতল জমিদারবাড়িটির প্রথম অংশে দ্বিতলা দরবার হল, পেছনে অন্দর মহল, বাড়ির সামনে রয়েছে মাঠ, জমিদার হেমচন্দ্রের দরবার ঘর, পেছনে রয়েছে বড় দুটি পুকুর। জমিদার বাড়ির আশপাশে আরো ৭টি সুরম্য ভবন আছে যেগুলো জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোন ও চার ছেলেমেয়ের বাড়ি। আর এই এঞ্জেল হাউজের ভেতরে বিশাল বড় একটা শানবাঁধানো পুকুর আর দশটি কুয়ো আছে। পুরো বাড়িটি নিপুণ হাতের শৈল্পিক ছোয়ায় পরিপূর্ণ। হেমচন্দ্র চৌধুরীর তিন বোনসহ সভ্রান্ত পরিবারের সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। মার্জিত রুচির কারণে পুরো পূর্ব বঙ্গজুড়ে তাদের সুনাম ছিল। হেমচন্দ্রের পরিবারে সদস্য রাও ব্রিটিশ প্রশাসনে চাকরি করতেন। হেমচন্দ্র তার বাবার মৃত্যুর পর জমিদারির দায়িত্ব পাওয়ার পড়ে তিনি তা বিস্তৃত করেন। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ মিলিয়ে তার জমিদারির এলাকা ছিল। তিনি শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং যোগাযোগ খাতে বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি ও অর্থ প্রদান করতেন। তার দানকৃত জমিতে গড়ে উঠে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ভূমি, অফিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর তিনি কলকাতায় চলে যান । হেমনগরে আর কখনই ফেরেননি। ১৯১৫ সালে ভারতের ব্যানারসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৪৭ সালের পর পরিবারের অন্য সদস্যরাও ভারতে চলে যান। পরে স্থানীয়রা জমিদার বাড়ি ঘেঁষে ১৯৭৯ সালে ‘হেমনগর খন্দকার আসাদুজ্জামান ডিগ্রি কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। বাড়িটি কলেজের অধীনে থাকলেও বহু বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ১৯৭১ সালে হেমনগর পরী দালান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি। এখান থেকেই কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার ও বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
এবি//দৈনিক দেশতথ্য//২৪ মার্চ ২০২৪//