এস এ শফি, সিলেট : ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটের সীমান্তবর্তী ৭টি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে।গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ২টি উপজেলা। এনিয়ে বন্যায় প্লাবিত হয়েছেন ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন মানুষ।বন্যা কবলিত উপজেলাগুলো হলো জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ।
উপজেলার পর এবার সুরমা নদীর পানি ছড়াগুলো উপচে সিলেট নগরীর নিম্নাঞ্চলে প্রবেশ করছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) মধ্যরাত থেকে সিলেট নগরীর নিম্নাঞ্চল এলাকাগুলোতে পানি ঢুকতে শুরু করে।শুক্রবার সিলেট নগরীর জামতলা, তালতলাস্থ সিলেটের ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স কার্যালয় ও তোপখানা, সোবহানীঘাটসহ বেশ কয়েকটি নিম্নাঞ্চল এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে দেখা যায়।
সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, উজানের পানি নেমে আসায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ছড়ার পানি নদীতে যাওয়ার কথা সেখানে নদীর পানি ছড়া উপচে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার ৬টা পর্যন্ত সিলেটে প্রায় ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের তথ্যমতে, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ০ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে কুশিয়ারা দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে অমলসিদ পয়েন্টে ২০৭ সেন্টিমিটার ও শেওরা পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।জানা যায়, বৃহস্পতিবার (৩০ মে) রাতে নগরীর তালতলাস্থ একটি ছড়ার পানি উপচে সিলেটের ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ে প্রবেশ করে। এরপরই ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেন। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সেখানে পানি রয়েছে।এদিকে, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ায় জরুরি সভা করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন।
সিটি মেয়র মো.আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশে ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. মখলিছুর রহমান কামরানের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় নগরভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে ওই ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুতের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। শুক্রবার থেকে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী প্রেরণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য নৌকার ব্যবস্থা, নিম্নাঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উপ-কেন্দ্রগুলো বন্যার পানিতে যাতে ডুবে না যায় সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সহযোগিতা প্রদান, নগরবাসীর জরুরি সেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালুসহ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে রান্না করা খাবার পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।সভায় জনস্বার্থে সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩ টন চিড়া, ৩ টন মুড়ি, গুড়, খাবার পানি, পানি বিশুদ্ করণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন ক্রয় করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের তথ্য মতে, শুক্রবার (৩১ মে) সকাল ৬টায় সিলেটের কানাইঘাট সুরমা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জ উপজেলার কুশিয়ারা নদীর অমলসিদ পয়েন্টে ২০৯ সেন্টিমিটার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য দুটি পয়েন্ট গোয়াইনঘাটের জাফলং ডাউকি পয়েন্ট ও সারি গোয়াইন পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে।এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে বিপদসীমার ২১৩ সেন্টিমিটার এবং শেওলা পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া, সারি গোয়াইন পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।এদিকে, জেলায় ৫৪৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে চালু করা হয়েছে। এরমধ্যে সাতটি উপজেলার ৩৪৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যা কবলিত এলাকার ৪ হাজার ৮০২ জন লোক আশ্রয় নিয়েছে।
গতকাল প্লাবিত উপজেলাগুলোর মধ্যে কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, শুকনো খাবার ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।ইতিমধ্যে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেট জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দুর্গত মানুষের খোঁজ নিতে জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান উপজেলাগুলোতে পরিদর্শন করেছেন। সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫টি উপজেলার মানুষের জন্য ২০০ বস্তা করে মোট ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ৫০ হাজার টাকা করে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্লাবিত এলাকা ছাড়াও আশপাশের উপজেলাগুলোকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।এদিকে, বন্যার্তদের স্বাস্থ্য সেবার প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর জানান, সিসিক মেয়র মো.আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র মখলিছুর রহমান কামরানের সাথে আলোচনা করে জরুরি সভা আহ্বানের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং ইতিমধ্যে জরুরি ত্রাণ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাথেও আলোচনা করেছেন।তিনি আরও জানান, দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য্য ও সাহসের সাথে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এছাড়াও তিনি মসজিদ, মন্দিরসহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় বিশেষ মোনাজাত-প্রার্থনা করার জন্য নগরবাসীর কাছে অনুরোধ জানান।যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম (০১৯৫৮-২৮৪৮০০) অথবা ভারপ্রাপ্ত মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সাথে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘উজানের পানি নেমে আসায় নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে সিলেট নগরীর ছড়ার পানি নদীতে পড়ার কথা সেখানে নদীর পানি উল্টো ছড়া উপচে নগরীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন জানান, বন্যা কবলিত উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে। জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যা-কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।
খালিদ সাইফুল, দৈনিক দেশতথ্য, ৩১ মে ২০২৪

Discussion about this post